আজ ৩০ এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর জগৎপুর গ্রামে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পাকবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৪২ জন নিরীহ মানুষকে। আহত করে প্রায় অর্ধশত মানুষ, জ্বালিয়ে দুই শতাধিক বাড়ি-ঘর।
স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলেও এই গ্রামে এখনো নির্মিত হয়নি শহীদদের স্মরণে কোন স্মৃতিসৌধ। অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর।
জানা যায়, জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঝিনাইগাতী উপজেলার জগৎপুর গ্রাম। সেদিন ছিল বাংলা ১৬ বৈশাখ, ৩০ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ৮টা।
জগৎপুরের সামনের শংকরঘোষ গ্রাম থেকে স্থানীয় রাজাকার মজিবর, বেলায়েত, নজর ও কালামের সহযোগিতায় পাক বাহিনী জগৎপুর গ্রামকে তিন পাশ দিয়ে ঘিরে ফেলে চালায় নির্বিকার হত্যাকাণ্ড। এসময় গ্রামবাসী কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই জীবন বাঁচাতে গ্রামের পেছনের দিকের রঙ্গবিলের দিকে দৌড়ে পালাতে থাকে।
কিন্তু বিলের মাঝখানে পানি থাকায় কেউ সাঁতরিয়ে আবার কেউ বিলের দুই পাড় ঘেঁষে পালাতে গেলে পাক সেনাদের গুলিতে শহীদ হন ৩৫ গ্রামবাসী। শুধু গুলি করে গ্রামবাসীকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি পাক সেনারা।
তারা শূন্য গ্রামের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে ছাই করে দেয়। ঘটনার প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা পর পাক সেনারা চলে যাওয়ার পর কিছু কিছু গ্রামবাসী ফিরে এসে দেখে তাদের বাড়ি-ঘর পুঁড়ে ছাই হয়ে গেছে।
এ অবস্থা দেখে অনেকেই চলে যায় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে। আবার অনেকেই রয়ে যায় গ্রামেই। পরে হিন্দু-মুসলিম অনেকেই তাদের আত্মীয়দের মরদেহ গ্রামের একটি জঙ্গলের কাছে গণকবর দেয়।
কিন্তু স্বাধীনতার ৫১ বছর পার হলেও এই গ্রামে এখনো নির্মিত হয়নি শহীদদের স্মরণে কোন স্মৃতিসৌধ। এখনো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে শহীদদের গণকবর। অথচ মুক্তিযোদ্ধের স্বপক্ষের সরকার আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়। কেনো এখনো চিহ্নিত করা হয়নি গণকবর, তৈরি করা হয়নি শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সেদিনের প্রত্যক্ষদর্শী ভুবল চন্দ্র দে বলেন, 'আমার ক্ষেতে কাজ করতেছিলাম, হঠাৎ করেই আক্রমণ করে পাকবাহিনী। পরে তারা গুলি করে হত্যা করে। দেশ স্বাধীনের পর এতদিন হলেও আমাদের কেউ খোঁজ নেই না। এই গ্রামে এসব কোন চিহ্নও নেই, তাই আমরা দাবি করছি, দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে সরকারিভাবে কিছু নির্মাণ করুক।'
ঝিনাইগাতীর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সামাদ বলেন, 'সেদিন পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে এই বিলে। এতদিন হয়ে গেলো এখানে একটা তালিকাও তৈরি করে দিতে পারেনি, এটা আসলে খুব দুঃখজনক।'
সাবেক জেলা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম হিরু বলেন, 'আমাদের ব্যর্থতার কারণে স্বাধীনতার এত বছর পরও জগৎপুরের আজো কোন স্মৃতিচিহ্নতো দূরের কথা, শহীদদের নামে তালিকা তৈরি করা হয়নি। চার বছর আগে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে জগৎপুরে একটি স্মৃতি ফলক নির্মাণের প্রস্তাবনা পাঠানো হলেও সেটি কি অবস্থায় আছে তা জানা নেই। তবে আমি শীঘ্রই শহীদের তালিকা তৈরি করে ও একটি নামফলকের জন্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি প্রেরণ করবো।'
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, 'জগৎপুর গ্রামে বেসরকারিভাবে একটি স্মৃতিফলক তৈরির উদ্যোগের কথা শুনেছি। তারপরও দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হবে। যাতে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ এবং শহীদদের নামের তালিকা তৈরি করা হয়।'
একাত্তর/এসজে
মন্তব্য
এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.