বাগেরহাটে করোনাকালে তিন হাজারের অধিক অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যা শিশুর বিয়ে হয়েছে বলে তথ্য উঠে এসেছে জেলা শিক্ষা অফিসের নিজস্ব অনুসন্ধানে। বাল্যবিবাহের শিকার এসব মেয়েরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, বালুবিবাহের শিকার এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশেরই পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেছে। তারা এখন স্বামীর সংসার করছে। এমনকি পঞ্চম শ্রেণিতে পুড়ায়া মেয়েদেরও বসতে হয়েছে বিয়ের পিঁড়িতে। এমনকি বিবাহের তিন মাসের মধ্যে নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক মেয়ের বিচ্ছেদেরও ঘটনা ঘটেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, করোনা মহামারিতে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সময়ে মেয়ে শিশুদের নিয়ে অভিবাবকদের অনিশ্চয়তা থেকেই এতো পরিমাণে বাল্যববাহের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতার কারণে এই ঘটনা বেশি ঘটেছে।
দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পর গত ১২ সেপ্টেম্বর খুলে স্কুল। এসময় শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারণ জানতে অনুসন্ধানে নামে জেলা শিক্ষা বিভাগ। সেই অনুসন্ধানেই বের হয়ে আসে করোনাকালে বাগেরহাট জেলায় তিন হাজার ১৭৮টি বাল্যবিবাহের তথ্য। এসময় পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েরাই বেশি বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে বলে জানা যায়।
আরও পড়ুন: ঝুঁকির মুখে ঢাবির ঐতিহ্যবাহী সলিমুল্লাহ মুসলিম হল
বাগেরহাট শহরের বাসাবাটি রহমানিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী বকুল (ছদ্মনাল) বিয়ের পিঁড়িতে বসে গত বছরের নভেম্বরে। অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা এবং লেখাপড়া নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিয়ে তার বিয়ে দেয়। বিয়ের পর সংসার করতে বকুল শ্বশুর বাড়ি যায়। কিছুদিন পর শুরু হয় স্বামীর নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে সে বাবার বাড়ি চলে আসে। পরবর্তীতে তিন মাসের মধ্যে বকুলের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। বর্তমানে সে আবারও পড়াশুনা শুরু করেছে। বকুলের বাবা পেশায় একজন হকার।
এদিকে শহরের জাহানাবাদ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী কল্পনার (ছদ্মনাম) বিয়ে হয় করোনা মহামারি শুরুর দিকে। পরিবারের সিদ্ধান্তে বিয়েতে রাজি হয় সে। ট্রাকের হেলপার স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করলেও কল্পনা পড়ালেখা ছাড়েনি। সে এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী।
একই বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী অপর এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে দুই মাস আগে। তার এখনো স্বাসীর সংসারে যাওয়া হয়নি। সেই পড়া লেখা করছে। বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা মিলেছে ওই দুই মেয়ের।
বাগেরহাট জেলা শিক্ষা বিভাগের তথ্য মতে , ২০২০ সালের ১৮ মার্চের পূর্ব থেকে চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জেলায় মোট বাল্যবিবাহের সংখ্যা তিন হাজার ১৭৮ জন। এর মধ্যে বাগেরহাট সদর উপজেলায় ৪৯৭টি, ফকিরহাটে ৩৯১টি, মোল্লাহাটে ৩৪৪টি, চিতলমারীতে ৪০৭টি, কচুয়ায় ৫১৬টি, রামপালে ২৩৭টি, মোংলায় ২১৮টি, মোড়েলগঞ্জে ৩৫৫টি এবং শরণখোলা উপজেলায় ২১৩টি।
আরও পড়ুন: নিবন্ধনের অনুমতি পেলো আরও ৮৫ নিউজ পোর্টাল
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, যারা বাল্যবিয়ের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে বাগেরহাট জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান বলেন, ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে জেলার ৯টি উপজেলায় শিক্ষা বিভাগের মাধ্যমে বাল্যবিয়ের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। তালিকা অনুয়ায়ী বাগেরহাট জেলায় গত দেড় বছরে তিন হাজার ১৭৮ জন মেয়ের ব্যাল বিবাহ হয়েছে।
বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের স্বাস্থ্য ও জীবনের জন্য হুমকি তৈরি হয় উল্লেখ করে বাগেরহাট সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. প্রদীপ কুমার বকসী জানান, অপরিমিত বয়সে গর্ভধারণ এবং সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় অনেক মা পৃথীবি থেকে হারিয়ে যায়। এমনকি মায়ের সাথে শিশুর মৃত্যুও হতে পারে।
বাগেরহাট জেলা বাল্যবিবাহ নিরোধ কমিটির সদস্য এবং নারী উন্নয়ন ফোরামের খুলনা ও বরিশাল বিভাগের আঞ্চলিক সম্বনয়কারি রিজিয়া পারভীন জানান, বাল্যবিয়ে বন্ধ করার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বড় ভূমিকা রয়েছে।
একাত্তর/আরএইচ
