বগুড়ায় বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সহ-সভাপতি ও বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক দুর্জয় বাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তী হত্যাকাণ্ডের ১৭তম মৃত্যু বার্ষিকীতে স্মরণসভা ও স্মৃতি পদক প্রদান করেছে বগুড়া সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিইউজে)।
রোববার (২ অক্টোবর) সকাল ১১টায় শহরের সার্কিট হাউজ মিলনায়তনে এ স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভার শুরুতে কালোব্যাচ ধারণ ও প্রয়াত সাংবাদিক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর আত্মার শান্তি কামনায় দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
বিইউজে সভাপতি আমজাদ হোসেন মিন্টুর সভাপতিত্বে স্মরণসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও দ্য ডেইলি অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল।
প্রধান অতিথি বলেন, দীপংকর চক্রবর্তীর মতো সৎ, নির্ভিক সাংবাদিক তরুণদের জন্য আদর্শ হয়ে থাকবেন। হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত বিচারের দাবি জানিয়ে যেতে হবে। নিরাপত্তা ছাড়া স্বাধীন সাংবাদিকতা হয়না জানিয়ে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা নিজ প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হবে।
ইকবাল সোবহান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধ বন্ধ করতে হবে। কোনো সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলেই তাকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানামূলে গ্রেপ্তার করা যাবে।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক শক্তি ও অপরাধী চক্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কয়টা মামলা হয়েছে, জানতে চাই। একদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের নিগ্রহ, দমন ও নির্যাতন করা এবং অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে গঠিত শেখ হাসিনা সরকারের সাংবাদিকবান্ধব ও গণমাধ্যমবান্ধব নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সাংবাদিকের কলম কেড়ে নেওয়ার জন্য, সাংবাদিকতার স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য এই আইন তৈরি হয়নি। অথচ সাংবাদিকদের কণ্ঠ রোধ করার জন্য এই আইনের অপপ্রয়োগ করা হচ্ছে।
প্রধার বক্তা মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সাংবাদিকরা এদেশে প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় দায়িত্ব পালন করছে। দেশে গত ৫০ বছরে শুধু একজন সাংবাদিক ফরিদপুরের দৈনিক সমকালের গৌতম দাস হত্যার বিচার নিম্ন আদালতে হয়েছে। হুমায়ন কবীর বালু, শামসুর রহমানসহ অন্যদের পরিবার এখনও বিচার পায়নি। দীপংকর চক্রবর্তী হত্যার তদন্ত পিবিআইয়ের মতো কোনো সংস্থারর হাতে পড়লে হয়তো ঘটনা বের হয়ে আসবে।
বুলবুল বলেন, এই সরকারের সময়ে সবচেয়ে বেইজ্জতি করা আইন হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। করোনা মহামারির এই সময়েও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫০০ মামলা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন যখন হয়, আমরা সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে আপত্তি তুললাম। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বললেন, এটা নাকি তার স্বপ্নের আইন। পৃথিবীর অনেক দেশই নাকি এ আইন অনুসরণ করবে। আইনমন্ত্রী বললেন, এ আইনের অপপ্রয়োগ করা হলে সাংবাদিকদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে তিনি দাঁড়াবেন। করোনা মহামারির এই সময়েও অন্তত ৫০০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হলেও আইনমন্ত্রীকে কোথাও দেখা পাওয়া যায়নি।
স্মরণসভায় উপস্থিত নিহত সাংবাদিক দীপঙ্করের ছেলে অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী বলেন, বিচার বিলম্বিত হওয়ায় তা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। মামলাটির তিনবার দায়সারা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর ডিবি আবারও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। প্রতিবেদনে ঢাকার হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত জাহাঙ্গীর আলম ওরফে রাজীব গান্ধীসহ চারজনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে রাজীব গান্ধী ছাড়া অন্য অভিযুক্তরা মৃত। এই মামলায় জজ মিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে। কেন একজন মানুষকে হত্যা করা হলো তা হয়তো কোনদিনই আমরা জানতে পারবো না।
স্মরণসভায় বক্তারা বলেন, দীপঙ্কর চক্রবর্তী ছিলেন একজন নির্বিবাদী মানুষ। দীর্ঘদিন পর পুলিশ এই হত্যাকাণ্ডে জঙ্গি সম্পৃক্ততা দেখিয়ে নাটক সাজিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে।
দুঃখজনক হলেও সত্যি এই ১৭ বছরে প্রায় ডজনখানেক তদন্ত কর্মকর্তা বদলিয়ে দীপঙ্কর হত্যা নিয়ে প্রহসন হয়েছে। ঘটনার সময় ও তার পরবর্তীতে সময় থেকেই মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টাও করা হয়েছে। অনেক আগে মামলার আলামত থানা থেকে গায়েব হয়ে গেছে, যার হদিস এখনও পুলিশ দিতে পারেনি।
বিইউজে সাধারণ সম্পাদক জে এম রউফের সঞ্চালনায় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন– বগুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি সম্পাদক মাহমুদুল আলম নয়ন, সাধারণ সম্পাদক আরিফ রেহমান, উত্তরাঞ্চল ফেডারেল সাংবাদিক পরিষদের (উফেসাপ) সভাপতি ও শিবগঞ্জ পৌর মেয়র তৌহিদুর রহমান মানিকসহ সিনিয়র সাংবাদিক এএইচএম আক্তারুজ্জামান, সমুদ্র হক, জয়নাল আবেদীন, মোহন আখন্দ, চপল সাহা, মাসুদুর রহমান রানা, বিধান চন্দ্র সিংহ, সাজেদুর রহমান সিজু প্রমুখ।
স্মরণসভা শেষে দীপঙ্কর চক্রবর্তী স্মৃতিপদক প্রদান করা হয়। এবছর তৃতীয় বারের মতো এই স্মৃতিপদক প্রদান করা হচ্ছে। ২০২১ সালে এ পদক পেয়েছেন প্রবীন সাংবাদিক ইত্তেফাকের সাবেক উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান আমিনুল ইসলাম চৌধুরী ও রবিউল করিম হেলাল এবং দৈনিক করতোয়ার বার্তা সম্পাদক প্রদীপ ভট্টাচার্য্য শংকর।
উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ২ অক্টোবর কাজ শেষে বগুড়ার শেরপুরে নিজ বাড়িতে ফেরার পথে বাড়ির কাছে দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হন সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তী। ওই ঘটনায় নিহত সাংবাদিকের বড় ছেলে পার্থ সারথী চক্রবর্তী বাদি হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করেন।
আরও পড়ুন: রিং আইডির পরিচালক গ্রেপ্তার
মামলাটি দীর্ঘসময় পুলিশ, ডিবি ও সিআইডি তদন্ত করে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ডিবি পুলিশ ওই হত্যাকাণ্ডে ইসলামী জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সম্পৃক্ততা বিষয়টি সামনে আনে। দেশের আলোচিত জঙ্গি হামলা হলি আর্টিজেনের অন্যতম আসামি রাজীব গান্ধী এই হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। মামলাটি বর্তমানে বিচারাধীন আছে।
একাত্তর/আরবিএস
