কথা ছিল বুধবার ছোট সন্তানকে ধুমধাম করে বরণ করবেন। তাই স্বামী শরিফুল ইসলামকে পাঠিয়েছিলেন ছেলে ও ছেলের নববিবাহিত স্ত্রী সুমি আক্তারকে আনতে। আর সাথে আদরের একমাত্র মেয়ে ও জামাই, পিতামাতা ভাই-ভাবী সহ ১৪ জন নিকট আত্মীয়কে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সে আনন্দ শোকে পরিণত হয়ে সব আনন্দ কেড়ে নেবে, আর বাড়িতে আত্মীয়স্বজনের আপ্যায়নের পরিবর্তে প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে খাবার আসবে এমনটা জানতেন না কাঁচোন বিবি।
এমনই চিত্র দেখা গেল জেলার চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সূর্যনারায়ণ গ্রামের মৃত শরিফুল ইসলামের বাড়িতে। বৃহস্পতিবার সকালে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটি ছিল নি:শব্দ। তবে আত্মীয়স্বজন ও লোকজনের ছিল আনাগোনা। নববিবাহিত সুমি শাশুড়ির খাটের পাশে বসে বাতাস করছেন। সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছেন। আর সদ্য বিবাহিত আল মামুন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রয়েছেন বাবার কবরের দিকে। এ দুই বাড়িতে শোকে আহাজারি করার মত কাউকেই দেখা গেলনা।
স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার আল মামুনের বাড়ি ও তার নানার বাড়িতে জ্বলেনি কোন চুলা। একসাথে তাদের নিকটাত্মীয় ১৪ জন মারা যাওয়ায় লাশ দাফন থেকে শুরু করে খাবার পত্র সবই স্থানীয় প্রতিবেশীরা করেছেন। অনেকে দুর দূরান্ত থেকে দেখতে আসছেন এ দুটি বাড়ি। অনেকে আসছেন সান্ত্বনা দিতে। বুধবার রাতে শরিফুল ইসলামের কবর দেয়া হয় তারই বাড়ির পাশে এবং শরিফুলের শ্বশুর বাড়ির ৭ জনকে কবর দেয়া হয় বাড়ির সামনে।
সদ্য বিবাহিত বর আল মামুন জানান, তিনি বিয়ে করতে গিয়ে পিতা, একমাত্র ভগ্নীপতি, নানা নানী, মামা মামি সহ একসাথে ১৪ জনকে হারাবেন এটা কল্পনাও করতে পারেননি। টানাটানির সংসারে পিতা ও তার রোজগারে দিন চলে গেলেও এখন পুরো সংসারটি তাকেই চালাতে হবে। সেই সাথে ৩ মামাতো বোন এতিম হয়ে যাওয়ায় তাদের নিয়েও রয়েছে দুশ্চিন্তা।
আরও পড়ুন: অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণে আগুন, ছুটতে গিয়ে নারী আহত
আর মামুনের মা বারবার কাঁদতে কাঁদতে একটাই আর্তনাদ, তার সংসার ও মৃত ভাইদের সংসারের দায়িত্ব কে নেবে।
স্থানীয় গ্রামবাসী রফিকুল ইসলাম জানান, এমনিতেই পরিবার দুটি শ্রম বিক্রি করে সংসার চালাতেন, তার উপর তাদের কর্মক্ষম ব্যক্তিরা মারা যাওয়ায় পরিবারগুলো বিপদে পড়েছে। বিশেষ করে বরের মামা সাদিকুল ও মামী ল্যাচন বেগম মারা যাওয়ায় তাদের ৩ কন্যা সন্তান পুরোপরি এতিম হয়ে গেল। তিনি আরও জানান, ছোট শিশুটি ৮ বছর, মেজটি ১২ বছর এবং বড়টির বয়স ১৫ বছর হওয়ায় তাদের দেখভাল করার কেউ থাকলোনা।
এদিকে নারায়ণপুর ইউনিয়নের ১৩ নং ওয়ার্ড সদস্য আজিম হোসেন জানান, বুধবারের বজ্রপাতে দুটি পরিবার একেবারে পথে বসে গেল। এ জন্য তাদের ইউনিয়নের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সহযোগীতার চেষ্টা করা হবে। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক মৃতের জন্য ২৫ হাজার টাকা এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সাদিকুলের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, নিহতের জন্য তাৎক্ষনিকভাবে জনপ্রতি ২৫ হাজার টাকা এবং আহতদের ৫ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনায় আহতরা সবাই বর্তমানে শঙ্কামুক্ত।
গত বুধবার (৪ আগস্ট) দুপুরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নে পদ্মা নদীর তেলিখাড়ি ঘাটে বজ্রপাত হলে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের সূর্য নারায়ণপুর গ্রামের ১৪ জন, একই উপজেলার চরবাগডাঙ্গার ১ জন এবং শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নের ২ জন বজ্রপাতে মারা যান। মৃতরা সবাই জনতারহাট থেকে নৌকাযোগে বরযাত্রী নিয়ে বৌভাতে কনের বাড়ি শিবগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ পাকা ইসমাইল মাষ্টারের পাড়া যাচ্ছিলেন।