নদী থেকে নামেছে পাহাড়ি ঢলের পানি। স্বাভাবিক পানিতে চলছে নৌকা, ড্রেজার মেশিনে তোলা হচ্ছে বালু। শত শত মানুষ কর্মব্যস্ত। এর মাঝেও পানিতে সাঁতার কেটে রোদে তাপ নিচ্ছে ছোট্ট একটি বিলুপ্তপ্রায় গিরগিটি। দূর থেকে প্রাণীটির নড়াচড়া দেখে কাছে ছুটে আসেন এক শ্রমিক। আকার আকৃতি রং অনেকটাই মিলিয়ে গেছে তখন।
তাড়াহুড়া করেই ওই শ্রমিকের কাছে ছুটে গেলেন তার কিছু সহপাঠী। সকলে মিলে শুরু হলো প্রাণীটিকে ধরার চেষ্টা। মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে প্রাণীও লুকিয়ে আছে নৌকার এক কোণে। তবুও নিস্তার নেই। নাছোড়বান্দা মানুষগুলো যে করেই হোক প্রাণীটিকে ধরবেই!
শুরু হয় লুকোচুরি খেলা। শেষ পর্যন্ত শ্রমিকদের ধৈর্যের কাছে হেরে যায় গিরগিটি। ধরা পড়ে।
আটকের পর প্রাণীকে একটি প্লাস্টিকের পানির বোতলে সামান্য কিছু ছিদ্র করে বন্দি করে রাখা হয়।
ছোট্ট চার পায়ের গিরগিটি। লম্বা কালো লেজ। পুরো শরীরে হালকা জলপাই বাদামি রং। তার উপর ধূসর কালো রঙের ফোটা। পায়ের আঙ্গুলগুলো বেশ লম্বা সাথে তীক্ষ্ণ নখ।
প্রাণীটিকে দেখতে একের পর এক মানুষ ভিড় করছেন শ্রমিকদের কাছে। নদীর একপাড় থেকে অন্যপাড়ে খবর ছড়াতেই ভিড় বাড়ছে। সবার মুখেই একটাই নাম ‘তক্ষক’। দাম নাকি কোটি টাকা।
অল্প এই জিনিসের জন্য কোটি টাকা আয়ের কথা শুনে হাসি ফুটেছে শ্রমিকদের মুখেও। অনেকটাই জেগে স্বপ্ন দেখছেন কোটি টাকার।
কোটি টাকার এই স্বপ্ন দেখার ঘটনা নেত্রকোণার দুর্গাপুরে কয়েকজন বালুর শ্রমিকের। শনিবার (২১ আগস্ট) বিকেলে পাহাড়ি নদীর তেরি বাজারে বালুচর থেকে প্রাণীটিকে ধরে বোতলবন্দি করে তারা।
দীর্ঘক্ষণ প্রাণীটিকে ধরে রাখার খবর শ্রমিক, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে জানতে পারেন স্থানীয় পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য এনিমেলস অফ সুসং সংগঠনের সদস্যরা।
বিকেল দিকে গিরগিটি উদ্ধারে মাঠে নামেন স্বেচ্ছাসেবকরা। অবগত করা হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে। বোতলবন্দি প্রাণীটিকে দেখার পরপরই শ্রমিক, বালু ব্যবসায়ী গাড়িচালকদের সাথে কথা বলে শুরু হয় উদ্ধারের চেষ্টা। প্রযুক্তির ব্যবহার করে উপস্থিত মানুষদের মাঝে তুলে ধরা হয় প্রাণীটির বিবরণী। ভ্রান্ত ধারনা নিয়ে বসে থাকা মানুষের মাঝে থেকে কাটতে থাকে ভুল ধারণা।
সর্বশেষ দীর্ঘক্ষণের প্রচেষ্টায় সরীসৃপ জাতীয় এই প্রাণীটিকে উদ্ধারে সক্ষম হয় স্বেচ্ছাসেবকরা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সকালে নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য কাজ করছিলেন স্থানীয় শ্রমিক হাসেম আলী। প্রাণীটির দেখে তক্ষক ভেবে বিভ্রান্তে পড়েন তিনি। পরে পাশেই কাজ করতে থাকা আরও বেশ কিছু মানুষের সহায়তায় গিরগিটিকে ধরে বোতলে ভরে রাখেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর শেষে বিকেল, তারপরেও মুক্তির লক্ষণ নেই। অহেতুক বোতলবন্দি প্রাণীটিকে ঝাঁকিয়ে ও কাঠি দিয়ে আঘাত করে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দেখেন উৎসুক জনতা।
স্বেচ্ছাসেবকদের উপস্থিতির পরেই ভুল ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে শুরু করেন শ্রমিকরা। স্বেচ্ছাসেবকদল উদ্ধারের পর ভীত ও অসুস্থ প্রাণীটিকে নিয়ে আসা হয় উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয়ে। চলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেয়া হয় গিরগিটি জাতীয় প্রাণীটিকে।
পরিবেশ ও প্রাণীবিদরা বলছেন, এটি একটি সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী। একে বাগান গিরগিটি নামে ডাকা হয়। বেশিরভাগ সময়ই বন-জঙ্গল ও জনমানবহীন জায়গায় বসবাস করে এরা। তবে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রজনন সময়ে প্রাণীগুলো বাহিরে আসলে বেশি নজরে আসে মানুষের। অনেক এলাকায় এটি রক্তচোষা নামে পরিচিত। একসময় প্রাণীটিকে প্রচুর দেখা গেলেও এখন এটি বিলুপ্তপ্রায়।
সেভ দ্য এনিমেলস অফ সুসং সংগঠনের সদস্য হুসাইন আহমেদ হাসান জানান, প্রাণীটিকে আটকে রাখার খবর শোনার পরপরই আমরা সোমেশ্বরী নদীর থেকে প্রাণীটিকে উদ্ধারে কাজ শুরু করি।
আরও পড়ুন: বগুড়ায় রোগী ও স্বজনদের মারপিটের অভিযোগ ইন্টার্নদের বিরুদ্ধে
উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মাহবুবুর রহমান জানান, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি এটি কোনো তক্ষক না। এটা গিরগিটির একটি প্রজাতি। গিরগিটির বিভিন্ন প্রজাতির মাঝে এটি একটি। এ প্রাণীগুলো ক্ষতি করে না। এরা বন-জঙ্গলে থাকতে পছন্দ করে। বন্যপ্রাণী আমাদের দেশের সম্পদ। এগুলোকে রক্ষায় সবার এগিয়ে আসা উচিত।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজিব উল আহসান বলেন, আমরা বিষয়টি জানার পর তাৎক্ষণিক স্থানীয় পরিবেশ ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সেভ দ্য এনিমেলস অফ সুসং সংগঠনের সদস্যদের প্রাণীটি উদ্ধারের নির্দেশনা প্রদান করি। পরবর্তীতে তারাই সোমেশ্বরী নদীর বালুচর থেকে প্রাণীটিকে উদ্ধার করে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে এটিকে বনে অবমুক্ত করা হয়েছে।
একাত্তর/আরএ