রাশিয়া ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞা নেমে এসেছে দেশটির ওপরে। সুইফটের মতো জরুরি লেনদেন সহায়ক প্ল্যাটফর্ম থেকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে রুশ ব্যাঙ্ক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
অভিযোগ, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের ওপর হামলা চালিয়েছে রাশিয়া। কিন্তু অন্য একটি রাষ্ট্রের ওপর এ ধরণের সামরিক হামলার ঘটনা বিশ্বে এই প্রথম নয়। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালিয়েছে লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানে। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের হামলা প্রায় নৈমিত্তিক।
তবুও ইউক্রেনে হামলার দায়ে রাশিয়ার ওপর বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার মিছিল দেখা গেলেও ইরাকে হামলার দায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নিষেধাজ্ঞার 'রা' নেই। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের হামলার প্রেক্ষিতেও দেখা যায় একই চিত্র।
রোববার (৬ মার্চ) নূর সাফা জুলহাজের সঞ্চালনায় একাত্তরের নিয়মিত আয়োজন একাত্তর মঞ্চে সঞ্চালক এমন এক প্রশ্ন হাজির করেন।
ওইদিন একাত্তর মঞ্চে যুক্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার মধ্যে আমরা বাস করি যেখানে বলা হয়ে থাকে সকল রাষ্ট্রই সমান। কিন্তু বাস্তবতা আসলে এমন নয়।
একটি সার্বভৌম দেশের সার্বভৌমত্ব আসলে বিশ্ব রাজনীতির আধিপত্যের বলয়ে কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসময় সঞ্চালক নূর সাফা জুলহাজ মনে করিয়ে দেন স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালের 'কিউবান মিসাইল ক্রাইসিস'-এর কথা। ১৯৬২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশি দেশ কিউবায় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মিসাইল ঘাঁটি স্থাপনের বিরুদ্ধে মার্কিনীরা প্রায় একটি পারমানবিক যুদ্ধ তথা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিচ্ছিলো।
সঞ্চালক উল্লেখ করেন, ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের বহু দূরে ইরাকের 'কল্পিত' অস্ত্রভান্ডারে ভীত হয়ে ইরাক আক্রমণ করে বসেন বুশ-ব্লেয়াররা।
ফলে সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার প্রতিবেশি দেশ ইউক্রেন পর্যন্ত মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটানোর চেষ্টাও রাশিয়ার ইউক্রেনে সামরিক অভিযানের কারণ কিনা এমন প্রশ্ন উত্থাপন করেন সঞ্চালক।
এর প্রেক্ষিতে ইউনিভার্সিটি অব নিউ অরলিয়েন্সের এমেরিটাস অধ্যাপক এবং সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোস্তফা সরওয়ার বলেন, একটি দেশের কোন জোটে গেলে তার স্বার্থ সংরক্ষিত হবে, তা নির্ধারণের স্বাধীনতা আছে। আর ইউক্রেন প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত হতে চেষ্টা করছে।
ড. সরওয়ার আরও বলেন, একুশ শতকে শুধুমাত্র রাশিয়াই একমাত্র দেশ যে অন্য দেশের ভূমি দখল করছে। জর্জিয়ার ভূমি দখলের পর তারা ইউক্রেনের ক্রিমিয়াও দখল করে নিয়েছে। ফলে তার প্রতিবেশী দেশগুলো নিশ্চয়ই রাশিয়ার কাছ থেকে নিরাপত্তা প্রত্যাশা করতে পারে না।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন আর রাশিয়া এক নয় উল্লেখ করে ড. সরওয়ার বলেন, রাশিয়ার নেতৃত্বে একনায়কতান্ত্রিক শাসক পুতিন। যে নিজেই সাবেক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ‘কসাই’র মতো দমন করেছে সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোতে।
সোভিয়েত আমলের পতনের পরও ন্যাটো জোটকে জিইয়ে রাখা কেন- এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তফা সরওয়ার বলেন, সোভিয়েত পতনের পরও সাবেক সোভিয়েতভুক্ত ১৪টি দেশ ন্যাটো জোটে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে।
অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বলেন, মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স জিইয়ে রাখতে যে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’, ‘সিকউরিটি গেম’, সেই অস্ত্র বাণিজ্য সম্প্রসারণে ন্যাটোর ভূমিকা অনস্বীকার্য। উইনিপোলার ওয়ার্ল্ড সিস্টেম বা মার্কিন নেতৃত্বে এক কেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেও ন্যাটোর ভূমিকা আছে।
বিশ্বের ৮০ দেশে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বিদ্যমান; জাপানে ১২০টি, জার্মানিতে ১১৯টি, ইতালিতে ৪৪টি, ব্রিটেনে ২৫টি। ওয়ারশ চুক্তির পরও ন্যাটোর এমন সম্প্রসারণ, মার্কিন মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের মাধ্যমে যুদ্ধ বাণিজ্য, অস্ত্র বাণিজ্যের সম্প্রসারণ কি এমন যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী নয়- সঞ্চালক জুলহাজের এমন এক প্রশ্নের জবাবে ড. মোস্তফা সরওয়ার বলেন, মার্কিন মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের গুরুত্ব এখন আর মার্কিন অর্থনীতিতে নেই। এখন ফেসবুক, গুগলের মতো তথ্য প্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোই মার্কিন অর্থনীতির চালিকা শক্তি।
ফলে এখনও সেই সোভিয়েত আমলের মার্কিন মিলিটারি ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সের বামপন্থী প্রোপাগান্ডা দ্বারা চিন্তা করা পিছিয়ে পড়া বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এসময় একাত্তর মঞ্চে যুক্ত বাংলাদেশ শিশু স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দ্য চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজির ডায়াগনস্টিক বিভাগের অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা বলেন, একজন মার্কিন সিনেটরের পুতিনকে হত্যার আহ্বান নিন্দাযোগ্য। একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিকের কাছ থেকে এমন আচরণ কাম্য নয়।
ড. সমীর আরও বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। কিন্তু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাক হামলার পরে কিন্তু একবারও এমন আশঙ্কা সামনে আসে নি।
ইরাক ইস্যুতে ফ্রান্স ইরাকে সৈন্য প্রেরণ করতে না চাইলে ফ্রান্সের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কিছু নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত জারি করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেসময় মার্কিনীরা বেশ ক’বছর তাদের প্রিয় ফ্রেঞ্চ ওয়াইন পান করতে পারেনি।
একাত্তর/জো