আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সংকটময় মুহূর্তে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের তৃতীয় ইউরোপ সফর করছেন জো বাইডেন।
চলছে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের চতুর্থ সপ্তাহ। যুদ্ধের এই মুহূর্তে টানেলের শেষে আলো তো দেখা যাচ্ছেই না, সেইসাথে মার্কিন-ইউরোপ সম্পর্ক নিকট ভবিষ্যতে কেমন দাঁড়াবে, তাও স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।
এমন সময়ে বাইডেন যখন ন্যাটোর শীর্ষ নেতাদের সাথে বৈঠকে বসেছেন, তখন তার সামনে অপেক্ষা করে আছে নানামুখী চ্যালেঞ্জ।
একতা প্রদর্শন
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর থেকেই প্রতিটি পদক্ষেপ মিত্রদের সাথে মিলেমিশে নেয়ার বিশেষ চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। এর ফলে কোনো কোনো সময় সিদ্ধান্ত দিতে ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশের জন্য অপেক্ষাও করতে হয়েছে তাদের।
কেননা, ৩০টি দেশের ভিন্ন ভিন্ন স্বার্থকে সমন্বয় করে সিদ্ধান্ত নেয়া সহজ কাজ নয়। তারপরও যুদ্ধের শুরুর দিনগুলো এক ধরনের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি করেছিলো, যার ফলে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পথে অনেক গতানুগতিক বাধা দূর হয়ে গিয়েছিলো।
তবে যতই দিন যাচ্ছে আর নিষেধাজ্ঞার ফলে মিত্র দেশগুলোর বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাচ্ছে, জোটের আভ্যন্তরীণ কোন্দল বের হয়ে আসার সম্ভাবনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ অবস্থায় বাইডেনের সফরের মূল লক্ষ্য হবে মিত্রদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে এই বার্তা দেয়া যে- রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী নীতির বিরুদ্ধে ন্যাটোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান অস্থায়ী নয়, বরং এটিই এখন 'নিউ নরমাল'।
শরণার্থী সংকট
বেলজিয়ামে ন্যাটো নেতাদের সাথে বৈঠকের পর পোল্যান্ডে দেশটির প্রেসিডেন্ট আন্দ্রেজ দুদার সাথে বৈঠক করবেন বাইডেন। গত কয়েকমাসে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিশেষ মনোযোগ পেয়েছে সাবেক এই সোভিয়েত স্যাটেলাইট রাষ্ট্র।
পোল্যান্ডের সাথে বৈঠকে ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা ও পোলিশ মাটিতে ন্যাটো সেনাদের উপস্থিতি বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, ইউক্রেন-পোল্যান্ড সীমান্তে শরণার্থীদের যে ঢল দেখা দিয়েছে সেটিই হবে বৈঠকের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।
লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার ফলে পোল্যান্ডের ওপর যে অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে, তা ঠিকঠাকভাবে মোকাবেলা না করতে পারলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তাই রাশিয়ার সাথে সংকটময় পরিস্থিতিতে পোল্যান্ডের ভূরাজনৈতিক অবস্থানকে গুরুত্ব দিয়ে নির্ভরযোগ্য ন্যাটো সদস্য হিসেবে এর অবস্থানকে ধরে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামরিক সমাধান
গত কয়েকমাসে ইউক্রেনের উর্দিধারী ও স্বেচ্ছাসেবী সেনাদের জন্য সামরিক সহায়তার দুয়ার অবারিত করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র দেশগুলো।
তবে এই সহায়তা যথেষ্ট নয় বলে বারবার বলে আসছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তার মতে, ইউক্রেনের দরকার আরও অত্যাধুনিক আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং রাশিয়ার যুদ্ধবিমানকে প্রতিহত করতে সক্ষম এমন ফাইটার জেট।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে আরও শক্তিশালী দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও, এটি বলার চেয়ে করা সহজ। পোল্যান্ড ইউক্রেনকে সোভিয়েত আমলের জেটবিমান সরবরাহ করার প্রস্তাব দিলেও, তাতে সাড়া দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
এখানে মূল উদ্বেগ হলো নতুন অস্ত্র সরবরাহ করলে তার বিরুদ্ধে রাশিয়ার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া এবং কীভাবে তা ইউক্রেনে সরবরাহ করা হবে।
স্লোভাকিয়া ও তুরস্কের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইউক্রেনে পাঠানোর ব্যাপারে তাদের সাথে কথাবার্তা চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখানে সফল হতে বাইডেনকে আরও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইউরোপ সফরের সময় এটি করতে সফল হলে সেটিকে যুক্তরাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবেই ধরে নেয়া যাবে।
নিষেধাজ্ঞার রোডম্যাপ
ইউক্রেন আক্রমণ করলে রাশিয়ার ওপর কঠোর ও অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে বলে হুমকি দিয়ে আসছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা। শুরুর দিকে একটু বেসামাল হলেও, শেষমেশ সেটাই করেছে তারা।
তবে বাণিজ্য, আমদানি-রপ্তানি ও রাশিয়ার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর এসব কঠোর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে রাশিয়া থোড়াই কেয়ার করে বলেই মনে হচ্ছে। ইউক্রেনে নিজেদের আক্রমণ পুরোদমে বজায় রেখেছে তারা।
সময়ের সাথে সাথে রাশিয়ার ওপর এসব নিষেধাজ্ঞার বিরূপ প্রভাব বৃদ্ধি পাবে বলে পশ্চিমা মিত্ররা দাবি করলেও, পুতিনকে শাস্তি দেয়ার নতুন উপায় খুঁজে বের করতে মার্কিন ও ইউরোপীয় নেতাদের ওপর চাপ দিনদিন বেড়েই চলেছে।
এ উপায়ের মধ্যে রয়েছে অলিগার্ক ও রাজনীতিবিদসহ রাশিয়ার উৎপাদিত শক্তি ও প্রযুক্তি পণ্য আমদানির ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ।
রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর এসব নিষেধাজ্ঞার খুব নাটকীয় প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা না থাকলেও, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া বজায় আছে এই ধারণা দেয়াও জরুরি বলেই মনে করে পশ্চিমা বিশ্ব।
চীন প্রশ্ন
গত ফেব্রুয়ারিতে শীতকালীন অলিম্পিকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে 'সীমাহীন' বলে আখ্যা দেন তারা।
এর মানে যদি এই হয় যে চীন সামনের মাসগুলোতে রাশিয়াকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া অব্যাহত রাখবে, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্রদের সব পদক্ষেপকে মাটি করে দিতে পারে।
গত সপ্তাহে রোমে বৈঠক করেন মার্কিন ও চীনা নিরাপত্তা উপদেষ্টা। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে চীনা প্রেসিডেন্টের দুই ঘণ্টার ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়।
তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্র একা বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না। চীনকে রাশিয়ার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে উদ্বুদ্ধ করতে আমেরিকা ও ইউরোপকে একসাথে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। আসন্ন জি২০ সামিটে রাশিয়ার অংশগ্রহণ নিয়ে চীনের সমর্থন বলছে, কাজটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব একটা সহজ হবে না।
আরও পড়ুন: শ্রীলংকার অর্থনীতিতে বিপর্যয় যে ছয়টি কারণে
যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইউরোপও চীনা পণ্যের বড় বাজার। মার্কিন ও ইউরোপীয় নিষেধাজ্ঞার হুমকির প্রভাব ইতোমধ্যে চীনের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।
গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে এক যুগ-নির্ধারণী ক্রান্তিকালে উপস্থিত হয়েছে পৃথিবী- এমন মন্তব্য করে আসছেন জো বাইডেন। তাই এই মুহূর্তে রাশিয়া ও চীনকে একই শিবিরে ঠেলে দেয়া তার জন্য বিপজ্জনকই হয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
একাত্তর/এসজে