আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জোড়া বিস্ফোরণে হতাহতের তালিকায় এখনো নতুন নতুন নাম যোগ হচ্ছে। গুরুতর আহতদের অনেকেই জীবন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সেই লড়াইয়ে হারও মানছেন অনেকে। ফলে বাড়ছে মৃতের তালিকা।
এরই মধ্যে শতাধিক মৃত্যুর নিশ্চিত খবর এসেছে। আর জখমের সংখ্যা দুই শতের কাছাকাছি। কাবুলের হাসপাতালগুলো ভারি হয়ে উঠছে হতাহতের স্বজনের আহাজারিতে।
জোড়া বিস্ফোরণে আফগান নাগরিকের পাশাপাশি ১৯ জন মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন আরো ৬০ জনের মতো। তাদের মধ্যে অনেকের অবস্থাই সংকটজনক।
এরই মধ্যে হামলার দায় নিয়েছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস-কে। আফগানিস্তানের আইএস হিসাবে পরিচিত এই জঙ্গিরা বর্বর ও ভয়ংকর হিসাবেই বিশ্বে পরিচিত।
তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর কাবুল বিমানবন্দরে শুরু হয় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় উদ্ধার অভিযান। বিদেশিদের পাশাপাশি আফগান নাগরিকরা বিমানবন্দরে জড়ো হতে থাকেন হাজারে হাজারে। সবার লক্ষ্য কোন মতে যৌথ বাহিনীর উড়োজাহাজে চড়ে বসা।
এতে করে ১৪ আগস্ট থেকে বিমানবন্দরে তৈরি হয় ভীষণ গোলমেলে আর বিশৃঙ্খল পরিবেশ। মরিয়া মানুষের হুড়োহুড়িতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গুলিও হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা জানায় আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। ঠিক তারপরেই বৃহস্পতিবার ঘটলো ভয়াবহ জোড়া আত্মঘাতী হামলার ঘটনা।
সামরিক ও গোয়েন্দা বিশ্লেষকরা বলেছেন, সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে তার দেখতে পেয়েছেন হামলা ছিলো সুপরিকল্পিত। নির্দিষ্ট সময়ে বড় ধরনের প্রাণহানি ছিলো বড় লক্ষ্য।
সেই লক্ষ্য পূরণে আইএস-কে সফল হয়েছে বলেই মনে করছেন তারা। বলছেন, বিমানবন্দরে গোলযোগপূর্ণ পরিবেশের সুযোগই নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এতে করে তাদের কাজ সহজ হয়েছে।
কাবুলের পতন হলেও বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের দখলেই রেখেছে মার্কিন সেনারা। তারা থাকতে বিমানবন্দরের প্রাচীরের ভেতরে। আর বাইরে থাকতো তালেবান যোদ্ধারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, হামলাকারীরা দুটো বিষয়কে সামনে রেখে হামলার সময়কে ঠিক করেছে। এক উদ্ধার অভিযানের শেষ প্রান্তে ব্যতিব্যস্ত থাকবেন মার্কিন সেনারা। দুই, দেশ ত্যাগে আরো মরিয়া হয়ে উঠবে আফগান নাগরিকরা। এতে ঢিলে হবে নিরাপত্তা নজরদারি।
ছক কষেই হামলার সিদ্ধান্ত নেয় আইএস। আর হামলার জন্য গোধূলি সময়কে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছে আত্মঘাতী।
প্রথমে মনে করা হয়েছিলো, জোড়া বিস্ফোরণের প্রথমটি হয়েছে বিমানবন্দরের বাইরে। আসলে তা নয়, প্রথমটি হামলাটি হয় বিমানবন্দরের কাছে ব্যারন হোটেল।
কাবুলে স্থানীয় সময় ছয়টার দিকে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে বিমানবন্দরের কাছে ব্যারন হোটেলে। সেখানে রাখা হয় কাবুল ছাড়তে চাওয়া মানুষকে।
বিশেষ করে কাবুল থেকে যাদের ব্রিটেনে যাবার কথা তারাই হোটেলটিতে আছেন। এদের মধ্যে ব্রিটিশ কর্মকর্তা ছাড়াও আফগান কর্মকর্তারাও ছিলেন।
হোটেলটি পাহারায় ছিলেন মার্কিন সেনারা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, হোটেলের বাইরে বিস্ফোরণ আওয়াজ পাওয়া যায়। তবে এতে কেঁপে উঠে পুরো হোটেল ভবন। এ সময় বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলির শব্দও পাওয়া গেছে। তবে কারা ছুড়েছে সেটি জানা যায়নি। সেই সঙ্গে জানা যায়নি ব্যারন হোটেলের বিস্ফোরণে হতাহতের সঠিক সংখ্যাও।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ পরেই আসে দ্বিতীয় বিস্ফোরণের শব্দ। ব্যারন হোটেলের কাছে রয়েছে বিমানবন্দরে অ্যাবি গেট। সেখানে প্রবেশের যতগুলো পথ আছে, তার মধ্যে একটি অ্যাবি গেট।
এই গেটেই মোতায়েন ছিলো মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনাদের ছাউনি। আর, আফগান ছাড়তে মরিয়া দেশটির নাগরিকদের সবচেয়ে বড় ভিড় সেখানেই ছিলো।
অ্যাবি গেটের প্রাচীরের পাশেই রয়েছে একটি সরু খাল। মাঝখানে সড়ক। সেখানেই বিমানবন্দরে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন হাজার হাজার মানুষ।
আর ঠিক ভিড়ের মধ্যেই দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি ঘটে। এ সময় ভিড়ের মধ্য থেকে একজনকে অ্যাবি গেটের দিকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে সেই ব্যক্তিই আত্মঘাতী।
দ্বিতীয় বিস্ফোরণটি এতো জোরালো ছিলো যে, অভিঘাতে বিমানবন্দরে অপেক্ষারত আফগানদের দেহ উড়ে গিয়ে সরু খালের পানিতে পড়তেও দেখা যায়।
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানাচ্ছেন, বিস্ফোরণের আগে প্রাচীরের বাইরে তালেবান যোদ্ধাদের ফাঁকা গুলি করতে দেখা গেছে। এরপরই জোরালো বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
আর এক মার্কিন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আত্মঘাতীর শরীরে বিস্ফোরক বোঝাই জ্যাকেট বাঁধা ছিলো। ব্যাক্তিটি ভিড়ের মধ্যে মিশে ছিলো। বিস্ফোরণের আগে সে নিজেকে আলাদা করে।
বিস্ফোরণের পরের দিন, শুক্রবার বিশ্ব গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ভয়াবহ হামলা ও হতাহতের ছবি। যা দেখে শিউরে উঠেছে বিশ্ব বিবেক।
বিমানবন্দরের সেখানে বিস্ফোরণ হয়, সেখানকার রাস্তার পাশে রয়েছে একটি সরু খাল। সেখানে পড়ে থাকা দেহসহ সামাজিক মাধ্যমে এসেছে হাসপাতালে জখম মানুষের ছোটাছুটির ছবিও।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, হামলার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করবেন তিনি। এজন্য যা যা করণীয়, তা করতে পেন্টাগনকে নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
একাত্তর/এআর