পৃথিবীর ভীষণ অসুখ করেছে, তাই দিনের পর দিন ঘরবন্দি জীবন যাপন করছেন
কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু সময় তো বসে নেই। নিয়ম মেনে ঘড়ির কাঁটা নিজের মতো এগিয়ে চলেছে।
এতদিন ধরে যাদের একটানা ঘরে থাকতে হচ্ছে কোন কাজকর্ম ছাড়াই, তাদের জীবনে একঘেয়েমি ভাব চলে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
তবে বাড়িতে বসে থাকা মানেই কিন্তু একঘেয়ে সময় কাটানো নয়। এই উৎকণ্ঠার সময়ে বই, সিনেমা কিংবা সিরিজ মনকে দিতে পারে ক্ষণিকের বিরাম।
যার পছন্দ যাই হোক, টানটান উত্তেজনায় ভরপুর অ্যাকশন, অহেতুক কমেডি কিংবা গভীর চিন্তার খোরাক- সবার জন্যই কিছু না কিছু আছে।
ব্যস্ত জীবনের কাজের চাপে যারা বই পড়া কিংবা সিনেমা দেখার কথা ভুলেই গিয়েছিলেন, তারা এই সময়ের জীবনকে উপভোগ করার মজা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারেন।
আর সিনেমা দেখার জন্য এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সিনেমা হলে যাওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। বিভিন্ন সহজলভ্য স্ট্রিমিং সার্ভিসেই মেলে হাজারো সিনেমা।
লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটতে হবে না, ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে ডাউনলোড করারও প্রয়োজন নেই। সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া এমন কিছু বই, সিনেমা আর সিরিজের খোঁজ নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সিনেমা/সিরিজ
লিটল ফিশ (২০২১)
(ওটিটি- হুলু)
সারা পৃথিবীতে আক্রমণ করেছে এক সংক্রামক ভাইরাস, আর এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে দু’জন মানুষের জীবন। মাস্ক পরে হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছে মানুষ, টেলিভিশনে সারাক্ষণ প্রচার হচ্ছে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের খবর। চেনা চেনা লাগছে? ঘাবড়ানোর কিছু নেই, এটি সত্যি ঘটনা নির্ভর কোন তথ্যচিত্র নয়। এই সিনেমার ভাইরাসটি কোন শারীরিক ব্যাধি নয়, বরং এর ছোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানুষের স্মৃতি। আমরা যে সময়ের মধ্যে যাচ্ছি তার সাথে এই গল্পের সাদৃশ্য নিতান্তই কাকতালীয়। দশ বছর আগে লেখা এজা গ্যবল এর ছোটগল্পের আলোকে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। কিন্তু কাছের মানুষগুলোকে সযত্নে আঁকড়ে ধরার আজকের যে তাড়না তার সাথে এর বিষয়বস্তুর রয়েছে অদ্ভুত মিল, আর সেটাই সিনেমাটিকে দিয়েছে অন্যরকম গভীরতা।
মিমি (২০২১)
(ওটিটি- নেটফ্লিক্স)
এই সিনেমার গল্প মিমি নামের একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত নারীকে নিয়ে, যার স্বপ্ন সিনেমার নায়িকা হওয়ার। তবে এই স্বপ্ন পূরণ করতে যে টাকার প্রয়োজন, তা জোগাড় করতে মিমি বেছে নেয় একটু ভিন্ন পথ। বিদেশি এক নিঃসন্তান দম্পতির জন্য সারোগেট মা হতে সম্মত হয় সে। আর তারপরই নানা বাধার সম্মুখীন হতে হয় তাকে। নেটফ্লিক্সে সদ্য মুক্তি পাওয়া সিনেমাটি একটি মারাঠি সিনেমার পুনঃনির্মাণ।
মহানগর (২০২১)
(ওটিটি- হৈচৈ)
ইংরেজি ভাষায় আন্তর্জাতিক স্ট্রিমিংয়ের যুগে বাংলা ভাষার সার্ভিসের সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য। এদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারতের স্ট্রিমিং সার্ভিস হইচই। মালিকানা ভারতের হলেও এতে আছে বাংলাদেশে নির্মিত ও বাংলাদেশের শিল্পীদের দ্বারা অভিনীত বেশ কিছু মৌলিক সিনেমা ও সিরিজ। এর মধ্যে সম্প্রতি হইচই ফেলেছে আশফাক নিপুণ নির্মিত ওয়েবসিরিজ ‘মহানগর’। ঢাকা শহরে একরাতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা নিয়ে নির্মিত সিরিজে অনবদ্য অভিনয় করেছেন মোশাররফ করিম। এপার-ওপার দুই বাংলায়ই দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছে এই সিরিজটি। দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক, সবাই এক কথায় এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
লুপিন (২০২১)
(ওটিটি- নেটফ্লিক্স)
ফ্রান্সে নির্মিত এই রহস্য থ্রিলারের প্রতিটি সেকেন্ড তুমুল উত্তেজনায় ভরপুর। কাহিনীটি একজন কন আর্টিস্ট কে নিয়ে, যে তার ছোটবেলার প্রিয় বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পাদন করে বিভিন্ন অপরাধ। কিন্তু এগুলো কি টাকার জন্য নিছক অপরাধ, নাকি এদের পেছনে লুকিয়ে রয়েছে গুঢ় কোন উদ্দেশ্য? বছরের শুরুতে পাঁচটি এপিসোড মুক্তি দিয়ে সাসপেন্সে রাখা হয়েছিল দর্শকদের, আর বাকিটা মুক্তি পেয়েছে গত মাসে। দুর্দান্ত অভিনয় আর থ্রিলিং কাহিনী দিয়ে ভালোই বিনোদন যোগাচ্ছে এটি।
বই
তোত্তচান: জানালার ধারে ছোট্ট মেয়েটি (২০১৮)
চৈতি রহমান (অনুবাদ)
জাপানি লেখিকা তেৎসুকো কুরোইয়ানাগি’র লেখা বইয়ের বাংলা অনুবাদ এটি। মূল বইটি প্রকাশ পায় ১৯৮১ সালে। আর বাংলাদেশে ২০১৮ সালে এর বাংলা অনুবাদ করেন চৈতি রহমান। অবশ্য এর আগে ২০১৪ সালে ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী মৌসুমি ভৌমিকও এটি অনুবাদ করেছিলেন। তবে সাদার মাঝে উজ্জ্বল গোলাপি বাগানবিলাসের প্রচ্ছদে চৈতি রহমানের বইটি সম্প্রতি বাংলাদেশের পাঠকদের মন কেড়েছে।
জাপানে শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশংসা করা হয় বিশ্বজুড়েই। সেখানে বেড়ে ওঠা তোত্তচান নামের ছোট্ট এক মেয়ের চোখে দেখা পৃথিবী নিয়েই বইটি। এটি মূলত আত্মজীবনীমূলক একটি বই। লেখিকা নিজের ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে উপজীব্য করেই এটি লিখেছেন। শিশুতোষমূলক বই বলা হলেও এতে রয়েছে গভীর জীবনবোধের চিন্তাধারা যা সব বয়সের পাঠকদের ভেতরের শিশুটিকে নতুন করে ভাবাবে।
দেখিতে গিয়াছি চক্ষু মেলিয়া (২০২১)
কৌশিক জামান
ঈদে বেড়াতে যেতে না পারার দুঃখ কিছুটা হলেও ঘোচানো যেতে পারে ঘরে বসে ভ্রমণ বিষয়ক বই পড়ে। ‘দেখিতে গিয়াছি চক্ষু মেলিয়া’ বইটি পড়ে মানসচক্ষে ঘুরে আসতে পারেন পৃথিবীর অপূর্ব সুন্দর কিছু জায়গা। বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন তরুণ ভ্রমণপিপাসুর বেড়ানোর স্মৃতি রোমন্থন করে লেখা ট্রাভেলগ ধারার বই এটি। ভ্রমণের বিভিন্ন খুটিনাটি অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি যত্নের সাথে লিখেছেন সাত তরুণ। এই বইটিরও প্রচ্ছদ বেশ নজরকাড়া।
পুণ্যাহ (২০২১)
তানভির অনয়
একদমই তরুণ একজন বাংলাদেশি লেখকের প্রথম বই ‘পুণ্যাহ’। প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে কয়েকজন যুবক-যুবতীর আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ জীবনের গল্প নিয়ে এগিয়ে চলে বইটি। প্রথম প্রথম এদের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে বলে মনে না হলেও কীভাবে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যায় তাদের গল্পগুলো। নিতান্ত ছোট দৈর্ঘ্যের বই, চট করে এক বসায় পড়ে ফেলার মত কিছু চাইলে এটি আদর্শ। আর দারুণ আকর্ষণীয় প্রচ্ছদটিও একেবারে বুকশেলফে সযত্নে সাজিয়ে রাখার মত।
দি অ্যান্থ্রোপসিন রিভিউড (২০২১)
জন গ্রীন
ইয়াং অ্যাডাল্ট বইয়ের জগতের সাথে যাদের জানাশোনা আছে তারা জন গ্রীনের নাম শোনেননি এমনটা খুবই দুর্লভ। তবে এবছর তিনি এসেছেন নিজের আগের বইগুলোর চেয়ে একটু ভিন্ন কিছু নিয়ে। গত বছর দুয়েক ধরে ‘দি অ্যান্থ্রোপসিন রিভিউড’ নামের একটি পডকাস্ট শো উপস্থাপনা করতেন তিনি। এই শো এর স্ক্রিপ্টগুলোরই রুপান্তর ঘটেছে একই নামের বইয়ে।
অ্যান্থ্রোপসিন কথাটির হুবহু বাংলা শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, তবে অনুবাদ করলে মোটামুটি অর্থ যা দাঁড়ায় তা হলো- ‘ভৌগলিক বিচারে বর্তমান কাল যেখানে জলবায়ু এবং পরিবেশের উপর মানুষের নিয়ন্ত্রণ সর্বাধিক’। এই অ্যান্থ্রোপসিনের বিভিন্ন মানুষকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড বা ঘটনাকে পাঁচটি তারার স্কেলে রেটিং করেন তিনি। এসবের মধ্যে রয়েছে হ্যালির ধূমকেতু থেকে শুরু করে হাওয়াইয়ান পিজ্জা, অথবা প্রথম দর্শনে প্রেম থেকে সূর্যাস্তের মহিমা। তবে এগুলোকে কেবল রিভিউ বললে ভুল হবে, কেননা প্রতিটির মূলেই রয়েছে লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর সূক্ষ্ম চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ। একটু ভিন্ন ধারার নন-ফিকশন পড়তে যারা পছন্দ করেন তাদের বইটি ভালোই লাগার কথা।
ক্লারা অ্যান্ড দ্যা সান (২০২১)
কাজুও ইশিগুরো
২০১৭ সালে ‘নেভার লেট মি গো’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর থেকে কাজুও ইশিগুরোর নাম মোটামুটি অনেকের কাছেই পরিচিত। নোবেল পাওয়ার পর তার প্রথম প্রকাশিত বই ‘ক্লারা অ্যান্ড দ্যা সান’ প্রকাশ পেয়েছে ২০২১ সালের মার্চ মাসে। সায়েন্স ফিকশনের সাথে আসল পৃথিবীর যোগাযোগ ইশিগুরোর বইয়ের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। এ বইটিতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
গল্পের মূল চরিত্র ক্লারা, যে একটি দোকানের ভেতরে বসে সেখানে আসা ক্রেতাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে। কিন্তু সে ওখানকার বিক্রেতা নয়, তার পরিচয় হলো সে একজন ‘আর্টিফিশিয়াল ফ্রেন্ড’ বা এক প্রকার রোবট যে মানুষকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য তৈরি। দোকানে বসে সে অপেক্ষা করে কেউ একজন তাকে একসময় বন্ধু হিসেবে কিনে নিয়ে যাবে। চারপাশের পৃথিবীটাকে লক্ষ্য করতে করতেই সে অনেক কিছু অনুভব করতে শেখে, আর একসময় বের করতে চেষ্টা করে ভালোবাসার মানে।
ল্যাম্প অ্যান্থোলজি (২০২১)
সংকলন
বর্তমান প্রজন্ম কবিতা পড়ে না কিংবা লেখে না এই ধারণাটি মোটেও ঠিক নয়। তাই কবিতা পড়তে যারা ভালবাসেন তাদের জন্য এবার ফেব্রুয়ারি মাসে এসেছে ‘ল্যাম্প অ্যান্থোলজি’। বিভিন্ন দেশের কবিদের লেখা ইংরেজি ভাষার কবিতার সংকলন এটি। বাংলাদেশি একজন তরুণ প্রকাশকের বলেই কিনা, এখানে জায়গা পেয়েছে অসংখ্য বাংলাদেশি উদীয়মান কবির লেখা। আজকের কবিরা কীভাবে ভাবছেন আর কীভাবে লিখছেন তার এক ঝলক দেখতে চাইলে বইটি ভালো উদাহরণ দিতে পারবে।
ছবি: ইন্টারনেট
একাত্তর/এসজে