কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সব ধরনের লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান-প্রদান সহায়ক ‘কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড’ (সিআরএস) অনতিবিলম্বে অবলম্বন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
মঙ্গলবার (৯ আগস্ট) টিআইবি থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ স্বাভাবিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হলেও প্রযোজ্য সুদসহ ঋণ পরিশোধের বোঝা পুরোটাই জনগণের ওপর পড়বে। এ প্রেক্ষিতে প্রায় সম্পূর্ণ বিনা খরচে কর ফাঁকি ও অর্থপাচার রোধের মাধ্যমে প্রস্তাবিত বৈদেশিক ঋণের বহুগুণ বেশি অর্থ বাৎসরিক ও টেকসইভাবে উপার্জন করার পথ সরকারের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে বলে মনে করিয়ে দিচ্ছে টিআইবি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলায় আইএমএফ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের উদ্যোগ স্বাভাবিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুদসহ এ ধরনের ঋণ পরিশোধের বোঝা পুরোটাই জনগণকে বইতে হয়। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আর্থিক সংকট, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমবর্ধমান ঘাটতি মোকাবিলায় বৈদেশিক ঋণ সহায়তাসহ অন্যান্য চলমান উদ্যোগসমূহ জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে গ্রহণ করা হয়েছে কি না! অর্থাৎ জনগণের ওপর ঋণের বোঝা না বাড়িয়ে বিকল্প উপায় অবলম্বনের পথ বিবেচনা করা রয়েছে কি না!’
গ্লোবাল ফাইনানসিয়াল ইন্টেগ্রিটির তথ্যানুযায়ী, ২০০৮-২০১৫ মেয়াদে চালান জালিয়াতির মাধ্যমে পাচার হওয়ার পরিমাণ বছরে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার, যা হালনাগাদ তথ্যপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ইতোমধ্যে কমপক্ষে ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘ক্রমবর্ধমান অর্থ পাচার বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ যে গগনচুম্বি এ বিষয়ে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। একইভাবে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের অর্থপাচারের সিংহভাগ আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যে মিসইনভয়েসিং বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে সংগঠিত হয়। যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, চলমান সংকটের মতো পরিস্থিতিতে কর ফাঁকি ও অর্থপাচার স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। উল্লিখিত বিশাল মাত্রার অর্থপাচার প্রতিরোধের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় বাড়ানোর জন্য কার্যকর সিআরএস অবলম্বন করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য আইনগত ও নৈতিক দায়িত্ব। যার সুফল প্রস্তাবিত আইএমএফ-এর মতো সংস্থার এককালীন আন্তর্জাতিক ঋণের তুলনায় বহুগুণে বেশি হারে ও বাৎসরিক ভিত্তিতে সুলভ ও টেকসইভাবে বৈদেশিক মুদ্রা তথা জাতীয় আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।’
বাংলাদেশের অথপাচারের গন্তব্য দেশসমূহ, এমনকি তথাকথিত কর-স্বর্গ দেশ বা অঞ্চলগুলোও ইতোমধ্যে সিআরএস আওতাভুক্ত হয়েছে এবং তথ্য আদান-প্রদান করছে উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংক-গোপনীয়তার জটিলতা থেকে মুক্তির উপায় এখন বাংলাদেশের নাগালের মধ্যে। সকল প্রভাব, ভয়-করুণা ও স্বার্থের দ্বন্দ্বের ঊর্ধ্বে থেকে স্বল্পমেয়াদে আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এবং মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদে টেকসইভাবে কর ফাঁকি ও অর্থপাচার নিয়ন্ত্রণে সিআরএস অবলম্বনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার উদাহরণ স্থাপনে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আশা করছি, অনতিবিলম্বে প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের পাশাপাশি সরকার জাতীয় পর্যায়ে প্রযোজ্য আইনি সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ওইসিডি’র উদ্যোগে প্রণীত এবং ২০১৭ সাল থেকে কার্যকর ব্যাংক ও আর্থিক খাতে দেশে-বিদেশে সব প্রকার লেনদেনের স্বয়ংক্রিয় তথ্য আদান-প্রদান সহায়ক কমন রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (সিআরএস)-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রতিবেশী একাধিক দেশসহ বিশ্বের ১২০টির বেশি দেশ তাদের দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত নাগরিকদের সব প্রকার ব্যাংকিং ও আর্থিক লেনদেনের তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবীক্ষণ করছে; যা দেশগুলোকে তথ্যের লেনদেনের মাধ্যমে একদিকে দেশে-বিদেশে কর ফাঁকি নিয়ন্ত্রণ ও রাজস্ব আদায় এবং অন্যদিকে অর্থপাচার প্রতিরোধ, চিহ্নিতকরণ, উদ্ধারসহ জবাবদিহি নিশ্চিতের সুযোগকে অবারিত করেছে।
একাত্তর/এআর