আর্জেন্টিনার রোজারিও শহরের মাঝে সাজানো-গোছানো ছিমছাম ছোট গ্রাম লা বাজাদা। এটি সান লুইস প্রদেশের অন্যতম একটি পৌরসভা এলাকা।
এই গ্রামের ঘরগুলোর বেশিরভাগেই দেওয়ালে দেখা যায় লিওনেল মেসির ছবি। কারণও বিশেষ কিছু। ১৩ বছর পর্যন্ত এখানেই ছিলেন ফুটবল তারকা মেসি। আর তিনি যেন এখনো এই গ্রামে সেই ছোট্ট মেসিটিই রয়ে গেছেন!
লা বাজাদায় যেখানে মেসির কিশোর বয়স কেটেছে সেখানে তার প্রতিবেশী ছিলেন আরাউস। তার ভাষ্য, আর দশটা শিশুর মতোই ছিলো মেসি। হই-হুল্লোড় করে অন্য বাচ্চাদের সাথে মেতে থাকতেন সারাদিন।
ছোট্ট মেসি
মেসির থেকে দুই বছরের ছোট বারবারা সসি (৩৩) ছোটবেলায় মেসিদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। মেসির সম্পর্কে বলতে গিয়ে আবেক আপ্লুত হয়ে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘তাকে (মেসি) এখন যেমন দেখেন- অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট, ছোটবেলায়ও তিনি এমনি ছিলেন।’
রোজারিওর স্থানীয় ক্লাব নিউয়েলস ওল্ড বয়েজ -এর যুবদলের হয়ে ছয় বছর খেলেছেন মেসি। ওই সময়ের মধ্যে ৫০০’র বেশি গোল করেছিলেন তিনি।
পরে ১৩ বছর বয়সে তিনি আর্জেন্টিনা ছেড়ে পাড়ি জমান স্পেনে। কারণ ছিলো অসুস্থতা।
ছোট বেলায় গ্রোথ হরমোন সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হন মেসি। সে সময় আর্জেন্টিনার কোন ক্লাবের পক্ষে তার চিকিৎসা খরচ বহন করা সম্ভব ছিলো না।
লা বাজাদাতেই কেটেছে মেসির শৈশব
সবশেষ বার্সেলোনা তার চিকিৎসার খরচ বহনের দায়িত্ব নিলে তিনি তাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন এবং স্পেনে যান।
স্পেনে বার্সেলোনা ক্লাবে দীর্ঘ ২১ বছর খেলেন মেসি। এই কাতালান ক্লাবেই সুপারস্টার হয়ে ওঠেন মেসি।
তিনি যতদিন ক্লাবে ছিলেন, ওই সময়ে বার্সা ৩৫টি ট্রফি জিতেছে। এর মধ্যে ১০টি লা লিগা, সাতটি কোপা দেল রে ও চারটি উয়েফা চ্যাম্পিয়নস লিগ।
লিওনেল মেসি ফুটবলের সর্বোচ্চ পুরস্কার ব্যালন ডিঅর জিতেছেন সাতবার।
তাছাড়া গত বছর আর্জেন্টিনার ক্যাপ্টেন হিসেবে খেলে ঘরে তুলেছেন কোপা আমেরিকা কাপের শিরোপা।
এখন তিনি চান নিজের সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপের কাপটি ঘরে তুলতে।
মেসির স্কুল
মেসি যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়তেন এখনো সেখানে তার স্কুলের নম্বরপত্র সংরক্ষিত আছে। নীল রেকর্ডের পাতায় লেখা আছে মেসির স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল। হাই স্কুলের প্রথম বর্ষ শেষ হওয়ার আগেই বার্সেলোনায় পাড়ি জমান মেসি।
মেসির স্কুল প্রশাসনের কর্মী সিন্টিয়া ভেগা গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘ও (মেসি) কখনও নিজের শেকড় ভোলেনি। ওর কথার আর্জেন্টাইন টানও কখনও মিলিয়ে যায়নি। ছেলেটা দেশ আর শহরকে ভালোবাসে। খাঁটি রোজারিনোর মতোই কথা বলে ও।’
মেসির স্কুলের নম্বরপত্র
২০০৫ সালে, ১৮ বছর বয়সে নিজের স্কুলে ফিরে গিয়েছিলেন মেসি। এরপর নানান সময়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য দিয়েছেন নিজের এলিমেন্টারি স্কুলে। কম্পিউটার থেকে শুরু করে অন্য প্রদেশে স্কুল স্কুল ট্রিপের খরচ পর্যন্ত যুগিয়েছেন মেসি।
মেসির বন্ধুদের বাবা-মা, যারা এখন দাদা-দাদি হয়ে গেছেন তারা মেসিকে নিয়মিত তাদের সন্তানদের আড্ডা দিতে এবং খেলাধুলা করতে দেখতেন। মেসির দাদি সেলিয়ার কথাও মনে আছে তাদের। ছোট্ট নাতিকে দলে নেওয়ার জন্য এই কোচ থেকে ওই কোচের কাছে ধরনা দিতেন তিনি।
মেসির বয়স যখন ১০, তখন মারা যান তার দাদি সেলিয়া। তার জীবনে দাদির অবদান অতুলনীয়। আর তাই গোল করার পরেই উদযাপন করার জন্য মেসি যখন আকাশের দিকে ইশারা করেন, সেটি তিনি করেন দাদির স্মরণে।
সাক্ষাৎকারে অনেকবার নিজের দাদির কথা বলেছেন বার্সা তারকা লিওলেন।
চার-পাঁচ বছর বয়স কিংবা তারও আগে থেকে যখন মেসি খেলা শুরু করেন দাদি তাকে সাথে নিয়ে মাঠে আসতেন।
দাদির সঙ্গে ছোট্ট মেসি
মেসি এক সাক্ষাৎকারে দাদির কথা স্মরণ করে বলেন, ‘আমাদের এক কাজিন (ফুটবল) খেলতো। ভিন্ন বয়সের হওয়ায় আমরা প্রায় প্রতিদিনই সেখানে যেতাম। একবার ৮৬ সালে জন্ম নেওয়া কিছু ছেলে খেলছিল। অর্থাৎ আমার চেয়ে এক বছরের বড় ছিলো তারা। তাদের একজন খেলোয়াড়ের প্রয়োজন ছিল —আমার দাদি কোচকে সে সময় বলেন ‘ওকে নিয়ে নিন।’ না, আমি কীভাবে তাকে দলে নেব, সে কত ছোট দেখেছেন! আঘাত পাবে—কোচ বলেছিলেন। কিন্তু দাদি অনড়—অনবরত বলছিলেন ‘নিয়ে নিন, নিয়ে নিন। ও পারবে।’
শৈশবে মেসি কাজিনদের সঙ্গে খেলা শুরুর সুযোগও পেয়ে গেলেন। এরপর মেসির দাদি কোচকে গিয়ে বললেন, ‘ওকে ফুটবল বুট কিনে দাও। আগামী সপ্তাহ থেকে ওকে অনুশীলনে নিয়ে যাব। এরপরই সব শুরু হলো। সময়টা অসাধারণ ছিল।’
খুব অল্প বয়সে মেসিকে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন তার দাদি। বার্সা তারকা ১০ বছর বয়সে থাকতে ভালোবাসার দাদিকে হারান।
এদিকে গত দশকে মাদকযুদ্ধের জন্য রোজারিওতে সহিংসতা বেড়ে গিয়েছিল চড়চড় করে। শহরটিতে হত্যাকাণ্ডের হার জাতীয় গড়ের চেয়ে চারগুণ বেশি। আগের প্রজন্মের মানুষরা লা বাজাদাকে শান্তিপূর্ণ এলাকা বললেও সেখানকার সর্বত্র ভেসে বেড়ায় অনিরাপত্তার গন্ধ।
ছোটবেলায় মেসির সঙ্গে ফুটবল খেলতেন বারবারা সসি। তিনি এখন ১৩ বছর বয়সী এক মেয়ের মা।
লা বাজাদার এক পরিত্যক্ত মাঠে হাঁটতে হাঁটতে সসি জানান, ‘সন্ধ্যা ৭টার পরে আমি আমার মেয়েকে বাইরে যেতে দেই না। ওর স্কুল বাড়ি থেকে মাত্র তিন ব্লক দূরে, তবু ওর একা একা স্কুল থেকে ফেরাটা মাত্র ক’দিন হলো স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছি।’
সড়কের অপর পাশের পৌর ভবন দেখালেন সসি। জানালেন, ক’দিন আগেই ওই ভবনের সামনে একজন গুলি ছুড়েছিল দুর্বৃত্তরা।
সসি আরো বলেন, ‘আমার বাচ্চাদের বলি, গুলির শব্দ শুনলেই মাটিতে শুয়ে পড়বে। আতশবাজির শব্দ শুনলেও। গোটা এলাকাটাই বদলে গেছে।’
তবে লা বাজাদার কিছু জিনিস এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। এই যেমন- মেসির প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এখনও সেখানে পড়ান। তবে কিছুদিনের মধ্যে তিনিও অবসর নেবেন। ৩৫ বছর ধরে স্কুলে দায়িত্ব পালন করছেন এই শিক্ষক।
আরও পড়ুন: মেসির চিন্তায় নিজ দল আর সকারুদের চিন্তায় মেসি!
নিজের প্রাক্তন ছাত্র যখন জীবনের নতুন ধাপে প্রবেশ করতে যাচ্ছে তখন তার জন্য শুভকামনা জানিয়ে এই শিক্ষক বললেন, ‘আশা করি ও (লিওলেন মেসি) যা কিছুতে বিনিয়োগ করেছে, তার প্রত্যেকটা জিনিস উপভোগ করবে।’
লা বাজাদায় এখন আর মেসি না থাকলেও সেখানকার সড়ক—যেখানে তার ফুটবল প্রতিভার প্রাথমিক বিকাশ হয়েছে—মেসির মাঝে ছাপ রেখে গেছে। এখানকার বিশাল ম্যুরাল আর বাসিন্দাদের স্মৃতিতে এখনও যেন বাস করেন সেই ছোট্ট লিওনেল মেসি।
সূত্র: আলজাজিরা। (অনুবাদ: হৃদয় আলম)
একাত্তর/আরএ/এসি
মন্তব্য
এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.