আরব্য রজনী কিংবা গ্রিক পুরাণ, ঠাকুমার ঝুলি কিংবা রাক্ষস খোক্কস দেও দানবের গল্প, হালের হ্যারি পটার কিংবা ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস- হাজারও বছর ধরে এমন কিছু প্রাণীর কথা উঠে এসেছে, যেগুলোর বর্ণনা বা চিত্র আমাদেরকে বিস্মিত করেছে।
সব সময়ই এই সব প্রাণী আমাদের দৃষ্টির মূল আকর্ষণেই থেকেছে। কিন্তু এই আধুনিক যুগে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার সময়েও কেনো এই প্রাণীদের গল্প আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে? আর আসলে সত্যটাই বা কি এই গল্প, মিথ ম্যাজিক পৌরাণিক কাহিনী বা কিংবদন্তীর পেছনে? এটা বুঝতে বাকি নেই কারো যে এগুলো আসলে ফ্যান্টাসি বা বানানো অতিমাত্রিক গল্প। তবে বিষয়গুলো এতোটাও সোজাসাপ্টা ভাবে দেখবার মত নয়।
আসল কথায় আসি। ড্রাগন নামের প্রাণিটি প্রায় সবার কাছেই কম বেশি পরিচিত। মুখ দিয়ে আগুন বেরোনো দীর্ঘ দেহী সরীসৃপ ধরণের প্রাণীটিকে নিয়ে গল্প তো সেই হাজার বছর আগের। ইতিহাস ঘেঁটে ড্রাগন প্রাণীটির জীবন্ত অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তাহলে কিভাবে এই প্রাণীর ধারণা এলো মানুষের মনে? কিভাবে গল্প তৈরি হলো, কিভাবে আকার পেলো নতুন একটি প্রাণী যার বাস্তব অস্তিত্বই নেই। শুরুটা কোথা থেকে? এই ড্রাগন মিথের পেছনে সত্যের ছটা কতটুকু?
চীনের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আর ড্রাগন নৃত্য যেন সমার্থক শব্দ। বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয় এই উৎসব। এই ড্রাগন জ্ঞান, ক্ষমতা এবং সম্পদের প্রতীক। বিশ্বাস করা হয় এই পরিবেশনা খারাপ আত্মা বা অপশক্তির জন্য ভয়ের আর মানুষের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে। কিন্তু সেটা ড্রাগনই কেনো? এই কল্পিত প্রাণীটি আমাদেরকে এতো মন্ত্রমুগ্ধ করে কেনো আজও?
শুধু চীনেই নয় বিশ্বে অনেক সংস্কৃতিতে ড্রাগনের কথা রয়েছে। তবে একটির চেয়ে আরেকটির ভিন্নতা স্পষ্ট। ইউরোপীয় ড্রাগন দেখতে অনেক ভয়ঙ্কর। নিঃশ্বাসের সাথে নাকে মুখে আগুন বেরোনো এই প্রাণী ডানা আর শিং যুক্ত। এশিয়ার ড্রাগন চিত্রিত সর্পিলাকার, জ্ঞানী, উপকারী হিসেবে। কিন্তু আপনি যদি ড্রাগনকে খুব কাছ থেকে দেখেন দেখতে পাবেন এর অনেক কিছুই ধার করা হয়েছে বাস্তব কোনো না কোনো প্রাণী থেকে। সেসব প্রাণী, যাদেরকে মানুষ ভয় পায়।
ড্রাগনের বিশাল এবং শক্তিশালী নখ দেখতে ঠিক ঈগলের নখের মত। কে না জানে ঈগলের নখ কতটা ধারালো আর বিধ্বংসী! এর তীক্ষ্ণ দাঁত এবং শক্তিশালী অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সিংহের মত। এবং এর আঁশ আর হিস হিসে জিহ্বা ঠিক সাপের মত। সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব জানাচ্ছে ড্রাগন আসলে তিনটি প্রাণীর সম্মিলিত একটি রূপ। সেসব প্রাণী, যেগুলোকে আমাদের পূর্ব পুরুষরা সবচেয়ে বেশি ভয় পেত। খুবই ইন্টারেস্টিং আইডিয়া, কিন্তু এই তত্ত্বের পেছনে কারণ কি?
একদল ভারভেট প্রজাতির বানরের ওপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই বানরগুলো ভয় পেলে একটা শব্দ করে। যেমন সাপ বা এই জাতীয় কিছু দেখলে এক ধরনের শব্দ করে সংকেত দেয়, শিকারি পাখি দেখে এক ধরনের শব্দ সংকেত দেয়, আবার বড় বিড়াল জাতীয় কিছু যেমন বাঘ সিংহ দেখে আরেক ধরনের ভয়ের শব্দ সংকেত দেয়। এই সংকেতগুলো বোঝায় সাধারণত এই তিন ধরনের প্রাণীকেই তারা সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
আর এই প্রজাতিটি মানুষের খুব কাছাকাছি বৈশিষ্ট্যের বলা যায়, কাজিন টাইপ আরকি। আমাদের মধ্যেও প্রায় একই ধরনের ভয়ের প্রবৃত্তি রয়েছে এই তিন ধরনের প্রাণীকে নিয়ে। বড় বিড়াল প্রজাতির প্রাণী, শিকারি পাখি এবং সাপ। সম্ভবত এই ভয় থেকেই তারা এই প্রাণীগুলোকে সবচেয়ে শক্তিশালী ভেবে তাদের একত্রিত একটা শক্তি প্রকাশ করতে চেয়েছে নিজেদের তৈরি সবচেয়ে শক্তিশালী ড্রাগনের মাধ্যমে।
ড্রাগনের কিংবদন্তীর পেছনে কিন্তু এখানে আরও একটি তত্ত্ব রয়েছে। যেটা ভয়ানক শক্তিশালী সরীসৃপ। যেটা পৃথিবীর বুকে হেঁটেছে লাখ লাখ বছর আগে। হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন ডাইনোসর। ১৮ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যালি অব বোনসে ডায়নোসরের ফসিল খুঁজে পায় ইউরোপীয়রা।
সেখানকার আদিবাসীরা জানে এগুলো কোনো বাস্তবিক প্রাণীরই হাড়গোড়। এই ফসিলগুলোকে সম্মান করেন তারা। ডায়নোসরের ফসিল সব মহাদেশেই পাওয়া গেছে। এই ডায়নোসরকি ড্রাগনের গল্পের পেছনে থাকতে পারে?
আদিবাসী অ্যামেরিকান মিথলজি ড্রাগনের মত প্রাণীকে চিত্রিত করেছে পায়াসা পাখি রূপে- পালকের বিশাল ডানা, হরিণের মত শিং, আর লম্বা সূচালো লেজ।
আর যুক্তরাষ্ট্রের সেনেকা মিথলজির গাসানডিথা ড্রাগন হ্রদে বাস করা, আগুনে নিশ্বাস ছাড়া জন্তু বিশেষ। সম্ভবত এই কল্পনাগুলো এই এলাকার ফসিল থেকে অনুপ্রাণিত।
এমনি আরও গল্প রয়েছে ইউনিকর্ন নিয়ে, জলদানব ক্র্যাকেন নিয়ে, অর্ধেক মানুষ অর্ধেক মাছ রুপি মারমেইড নিয়ে! পেগাসাস থেকে হিপোগ্রিফ, থেস্ট্রলস থেকে থান্ডারবার্ডস, ডানাযুক্ত অনেক ম্যাজিক্যাল ক্রিয়েচার খুঁজে পাওয়া যায় যেগুলো উড়ে বেড়ায়। এই কল্পনার জন্তুগুলো মাটি, সাগর, আকাশ দাপিয়ে বেড়ায় সমানতালে।
মুখে মুখে চলে আসা গল্প বা বইপত্রে লেখা কাহিনীগুলো বর্তমানে বাস্তবসম্মত প্রাণীর রূপ পেয়েছে কম্পিউটার প্রযুক্তির কল্যাণে। এতোটা জীবন্ত তারা আগে কখনও ছিলো না। তবে সেই সাথে এটা দেখেও বিস্মিত হই কিভাবে প্রকৃতি মানুষকে এমন সব নতুন নতুন সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত করেছে।
কিন্তু বড় পর্দায় ফ্যান্টাস্টিক বিস্ট তৈরি হলো কিভাবে? কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেজারি- সি জি আই। অর্থাৎ কম্পিউটারে তৈরি করা ইমেজ বা চিত্র। তাহলে কি এইসব প্রাণী তৈরি করতে কম্পিউটারে সারাক্ষণ অঙ্ক কষতে হয়?
নির্মাতারা বলছেন, এই যে ভিডিও চিত্রগুলো তৈরি করা হয় তা আসলে সৃজনশীলতা ও প্রযুক্তি এবং এনিমেশনের সাথে আমাদের অনুপ্রেরণার মিশেলে তৈরি। আমরা এমন করে তৈরি করি যেন দর্শকরা বিশ্বাস করে এগুলো বাস্তবিকই আছে।
আর এর মূল উপাদান আমরা খুঁজি প্রকৃতিতেই। হয়তো কোনো একটা ফুলের পাপড়ি থেকে নেয়া হয়েছে একটা থিম, হয়তো সাগরের বুকে জন্ম নেয়া কোনো শ্যাওলার স্রোতে দুলতে থাকা গতি যোগ করা হয়েছে কোনো একটা প্রাণীর মধ্যে, কোনো কোরালের অবয়বে মেলানো হয়েছে অন্যকিছু... অর্থাৎ সবই আছে প্রকৃতিতে।
কিন্তু পৃথিবীতে কোথায় এগুলো শুরু হয়েছে? কখন আমরা এই মিথিক্যাল ক্রিয়েচারগুলোকে ইম্যাজিন করতে শুরু করলাম? যখন আদিম মানুষ চিত্র আঁকতে শুরু করলো তখন থেকে আমরা জানতে পারলাম এসবের অস্তিত্ব। আমার চারপাশে যা দেখি তাই চিত্রিত করতে শুরু করলাম। প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষ, জীবজন্তু। শুধু দেখা বস্তু নয়, সেই সাথে কল্পনা করেও আঁকতে থাকে মানুষ। গুহাচিত্রে, পাথরে আঁকায় সেগুলো আমরা দেখতে পাই।
৪৪ হাজার বছর আগের চিত্রও পাওয়া গেছে। কেউ জানে না এই কল্পনার ইমেজগুলো কেন তৈরি করেছিলো তারা, তবে সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা হতে পারে, এটা গল্প বলার প্রাথমিক ধাপ ছিলো। মানুষ কেন গল্প বলে, এর উত্তর খুঁজেছেন জেকে রওলিং, তিনি বলেন, এই ইম্যাজিনেশন আসলে কালচার। মানুষের একটা ধারণা এগুলোর মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে। আর মানুষ যা দ্যাখেনি তা কল্পনা করা তার পক্ষে কঠিনই নয়, অসম্ভব বলা চলে।
ফ্যান্টাসটিক বিস্টস আমাদের সাথে আছে সেই আদ্যিকাল থেকে। একেবারে প্রথম গুহায় আঁকা কাল্পনিক জন্তু থেকে আজ পর্যন্ত। আজ তাকে আমরা দেখছি বিশাল পর্দায় প্রায় বাস্তবিক আকারে। এগুলো আমাদের নিজস্ব ইতিহাসের মৌলিক অংশ।
এই সব ম্যাজিক্যাল এনিমেশনের নিয়ে আমাদের সীমাহীন কৌতূহল, আমাদের হয়তো সেই জায়গায় নিয়ে যাবে ,যেখানে আমরা আবিষ্কার করবো নতুন কোনো প্রজাতি। যদি আমরা আমাদের চোখ ও মন খোলা রাখি, কে জানে কি আছে তার ওপারে? এই পৃথিবী একটি ম্যাজিক্যাল প্লেস। ফ্যান্টাস্টিক বিস্টস দেখাচ্ছে এই পৃথিবীতে অনেক কিছুই আছে আবিষ্কারের।
ভিডিওসহ ফ্যান্টাস্টিক বিস্টের গল্প শুনতে ক্লিক করুন এই ভিডিও লিংকে।
একাত্তর/এসজে
মন্তব্য
এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.