ঢাকা ২০ মার্চ ২০২৩, ৬ চৈত্র ১৪২৯

মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মূল্যবোধ

নূর সাফা জুলহাজ
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২২ ১১:৫৫:১৫ আপডেট: ২২ জানুয়ারী ২০২৩ ১৩:৫৭:৫৬
মুক্তিযুদ্ধ ও আমাদের মূল্যবোধ

মুক্তিযুদ্ধ যেন দূরের ঘটনা! রাজনীতির কিংবা ভারী পাঠ্যপুস্তকের বিষয়। আমাদের প্রজন্ম তো বটেই, পরের প্রজন্মগুলোরও, মুক্তিযুদ্ধের সাথে অন্তরের যোগ কম! বিজয়ের পঞ্চাশে, আজকের দিনে, আমার কেন এমন হলো?

মনে হলো কারণ, আমাদের অনেক অনেক পরিবারে ছড়িয়ে  থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের গল্পগুলোকে আমরা পরিবারের গল্পের বিষয় করিনি, সমাজের আলাপে পরিণত করিনি। 

শুধু নয় মাসের রণাঙ্গনের যুদ্ধকে আমাদের রাজনীতি বার বার মুক্তিযুদ্ধ হিসেবে  হাজির করেছে। 

ফলে ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে বদলেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস!

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান। আমার বাবা যখন মুক্তিযুদ্ধে যান বয়স তাঁর বিশ বা একুশ। সেসময় তিনি ছিলেন সিটি কলেজের ছাত্র এবং একইসাথে চাকরিরত পাওয়ার স্টেশনে, চট্টগ্রামে। পাকিস্তানিদের নৃশংস আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই তিনি চাকরিতে ইস্তফা দেন, হামলার প্রতিবাদে। বন্ধুদের নিয়ে ভারতে চলে যান, গেরিলা ট্রেনিং নেন। অংশ নেন সম্মুখ যুদ্ধে, প্রথমে রংপুর অঞ্চলে, পরে সিলেট অঞ্চলে। 

তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, কি বিশ্বাস, কি আদর্শে তাড়িত হয়ে গেলেন অমন একটা অসম যুদ্ধে? তিনি বলেন,

'আমরা তো দেশের জন্য যুদ্ধে করেছি। ওরা কিসের জন্য যুদ্ধ করেছে?! আমরা জানতাম ওরা পিছু হটবে।'

আমার মেয়ে ইভিতা তাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কাছে তখন 'দেশ' মানে কি ছিলো? বাবা বলেন, 'আমরা সবাই, আমাদের চারপাশের সকল মানুষই তখন দেশ!' ‘পাকিস্তানিরা যা করেছে আমাদের সাথে, আমরা তা নিজেদের সাথে করবো না, সেটাই স্বাধীনতা’।

আমার বাবার মতো এমন লক্ষ  মুক্তিযোদ্ধা আছেন লক্ষ পরিবারে। আমরা কি তাদের গল্পগুলোকে সমাজের বিষয় করেছি? আমরা কি তাঁদের ঘরে ঘরে আজ শুভেচ্ছা জানিয়েছি? আমরা কি তাঁদের সম্মানিত করেছি?

তাঁদের কি জানিয়েছি যে, আমরা তাঁদের জন্য গর্বিত? 

তাঁদের সেই স্বপ্নের গল্প কি এখন আমাদের জীবনের গল্প? 

তাঁদের সাহসকে কি করেছি আমাদের সাহস ? 

তাঁদের গল্প কি আমরা আমাদের পরের প্রজন্মের সাথে করি?

এজন্যই আমার অনেক সময় মনে হয় মুক্তিযুদ্ধের সাথে আমাদের অন্তরের যোগ কম! আমরা মনে করি এটা একটা দূরের রাজনীতি, টেক্সট বইয়ের বিষয়, কয়েকটা তারিখ, নয় মাসের যুদ্ধ!  

অন্তরের বিষয় হলে, সেদিন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ও  মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বে স্বাধীন দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া লক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা যা চেয়েছিলেন তার মূল্য দেয়াই হতো সমাজের মূল্যবোধ।

একটি অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মর্যাদার, গণতান্ত্রিক দেশ 

নির্মাণই হতো আমাদের রাজনীতি। 

জাপান ২য় বিশ্বযুদ্ধে নৃশংসতা করেছে, আধিপত্য বিস্তারে হামলা করেছে নানা দেশে। শেষে পরাজিত হয়েছে। 

পরাজয় থেকে শিখেছে। তাই তারা বদলে গেছে মানুষ হিসেবে।

আর আমরা বিজয়ী। পাকিস্তানের মতো প্রবল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিজয়ী! প্রতিরোধ করে, লড়ে, ত্যাগে, জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ বিজয়। কিন্তু কিছু কি শিখেছি? আমরা কি বদলেছি?

ত্রিশ লক্ষ শহীদ, সোয়া চার লক্ষ নারীর ধর্ষণ! 

এতো মৃত্যু, এতো নিপীড়ন!  তবু আজ মনে হয়,

আর কতো মূল্য দিলে তবে আমাদের মূল্যবোধ দাঁড়াবে?!

মুক্তিযুদ্ধ হোক আমাদের মূল্যবোধ।

তবেই কেবল, যে শিশু আজ পঞ্চাশের বাংলাদেশে জন্মালো, তার জন্য তৈরি হবে এক মানবিক মর্যাদার দেশ।

মুক্তিযোদ্ধারা একটা দেশ দিয়েছেন আমাদের! 

এক জীবনে এর চেয়ে বড় গিফট আর কি হতে পারে!

আর আমরা, কি গিফট রেখে যাচ্ছি আমাদের সন্তানদের জন্য?

সকল মুক্তিযোদ্ধার জন্য অতল শ্রদ্ধা!



লেখক: চিফ প্ল্যানিং অ্যান্ড কনটেন্ট এডিটর

একাত্তর টেলিভিশন, ঢাকা।


একাত্তর/এসি





মন্তব্য

এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.

আপনার মন্তব্য লিখুন

Nagad Ads