বিএনপি নেতারা ইতিহাস বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিদেশি নেতাদের বিভ্রান্ত করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ, সাবেক স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার শাসনামলকে হোয়াইটওয়াশ করে বিদেশিদের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন দলটির নেতারা।
মঙ্গলবার (২১ মার্চ) এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম ইন্ডিয়া টু ডে।
জানা যায়, জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবেকে লেখা এক চিঠিতে বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে ‘বাংলাদেশের মহানায়ক’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে ইতিহাস বিকৃত করেছে। ২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি পাঠানো ওই চিঠির একটি ছবিও প্রকাশ করা হয়েছে। জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদার সফরকালে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
এই চিঠিতে আবারও ইতিহাস বিকৃত করে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে জিয়াউর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়। যদিও বিখ্যাত লেখক অ্যান্থনি মাসকারহেনাস বাংলাদেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসকের আমলকে ‘রক্তাক্ত শাসনের সূচনা’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাকে ‘গণতন্ত্রের অভিভাবক’ হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টায় মরিয়া।
শুধু তাই নয়, ওই চিঠিতে আরও দাবি করা হয়েছে, ‘বিএনপি বাংলাদেশে বহুদলীয় বহুত্ববাদী গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেছে।’
গবেষকরা বলছেন, এ ধরনের কাজ বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্ব নেতাদের বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা।
তারা মনে করেন, বিএনপির এমন দাবি তাদের কালো ইতিহাসকে মুছে ফেলার চেষ্টা। কারণ বিএনপি কীভাবে গঠন হয়েছিল, কীভাবে প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়া জামায়াতে ইসলামীর মতো উগ্র মৌলবাদী শক্তিকে তুলে ধরেছিলেন বা তৎকালীন স্ব-স্বীকৃত যুদ্ধাপরাধী ও হত্যাকারীদের সহায়তা করেছিলেন তা উঠে আসে না। দেশের স্বাধীনতার ছয় বছরের মধ্যে দেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে এসব রাজনৈতিক দল নিয়েই রাজনীতি করেছিলেন জিয়া।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, জেনারেল জিয়ার করা রক্তপাতের ইতিহাস যাতে জাপান ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে প্রকাশ না পায় সেজন্যই এমন চেষ্টা করা হয়েছে।
বিশিষ্ট গবেষক অজয়দাস গুপ্ত বলেন, জেনারেল জিয়া দেশের প্রথম সামরিক স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন এবং বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে অসংখ্য সৈন্য ও অফিসারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দমন-পীড়নের ঢেউ তুলেছিলেন। অথচ তার অনুসারীরা এখন তাকে স্বাধীনতা, সুশাসন ও স্বাধীনতার আলোকবর্তিকা হিসেবে তুলে ধরেন।
ভুল ইতিহাস তুলে ধরছে বিএনপি
দেশের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকে মুছে ফেলার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেছিলেন জেনারেল জিয়া। বাবার ধারাবাহিকতায় একই পথ অনুসরণ করেছেন তারেক রহমানও। তিনিও সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের বানানো ইতিহাস ও তাদের দেখানো রাজনীতির পথেই হেঁটেছেন।
২০১৪ সালে জেনারেল জিয়াকে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছিলেন তারেক। তার দাবি, জেনারেল জিয়া ছিলেন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। ওই সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও তারেক রহমানের সঙ্গেই সুর মেলান।
কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তারেককে তুলনা করে সে সময় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিপ্লবের পর কাস্ত্রো আদালতে বলেছিলেন: 'আমার ফাঁসি হতে পারে, কিন্তু ইতিহাস আমাকে আলিঙ্গন করবে। এবং আমরা জানি ইতিহাস তাকে (কাস্ত্রো) গ্রহণ করেছে।’
দেশের শীর্ষ গবেষক ও নন্দিত লেখক সৈয়দ বদরুল আহসান বলেন, ‘বিএনপিকে স্পষ্টতই তারেক রহমানকে মুক্ত করতে হবে। ইদানীং, জেনারেল জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার পলাতক বড় সন্তান ইয়াহিয়া খান শাসন ও তার দোসরদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস বিকৃত করতে ব্যস্ত। প্রায় ৫০ বছর-বয়সী একজন ব্যক্তির এই গণনামূলক পদক্ষেপটি দেশের কাছে নতুন মিথ্যা বলার জন্য শুধুমাত্র অজ্ঞতা প্রকাশ করে যা তার চিন্তাভাবনার অন্তর্নিহিত। তিনি ভুলে যান তার বাবাই ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন।’
‘তারেক সম্ভবত ১৯৭২ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় তার বাবার লেখাটি পড়েননি। যেখানে জিয়া কার্যকরভাবে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিলেন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে,’ যোগ করেন দেশের শীর্ষ ইংরেজি দৈনিকের সংবাদকর্মী বদরুল।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জেনারেল জিয়ার ভূমিকা
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই সামরিক বাহিনী দেশের শাসনভার গ্রহণ করে ও ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকে। এটিই দেশের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অপ্রত্যাশিতভাবে থামিয়ে দেয় ও জামায়াতে ইসলামীর আড়ালে যুদ্ধাপরাধীদের উত্থান ঘটায়।
ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক সংবাদদাতা অনুসন্ধানী সাংবাদিক লরেন্স লিফশুল্টজ বলেন, ‘তার দৃষ্টিতে, অন্যদের ব্যবহার ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং সহিংসতা ব্যবহার করার ক্ষমতার ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়া একজন ‘‘সাইকোপ্যাথ’’ ছিলেন।’
তিনি বলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের পিছনের লোকেরা জেনারেল জিয়ার সমর্থন ছাড়া কিছু করতেন না। যেমন জেনারেল জিয়া আমেরিকার সমর্থন ছাড়া নড়তেন না। আমার দৃষ্টিতে, এটি আরও তদন্ত করা দরকার।’
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংবাদিকতা করা বিবিসির প্রবীণ সাংবাদিক স্যার মার্ক টুলি বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পরে দেশে একটি ইসলামিক ধারা কাজ করছে। তারা বাংলাদেশকে আরও ইসলামিক হওয়ার জন্য চাপ দিতে চায়।’
এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার ফাঁসি কার্যকর করার জন্য দায়ী জেনারেল জিয়া
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের ১৯ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেনাপ্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়ার উত্থানের সাথে সাথে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বীর মুক্তিযোদ্ধারা জানতেন, তারা পাকিস্তান প্রত্যাবর্তনকারীদের জন্য সমস্যায় পড়তে যাচ্ছেন। জেনারেল জিয়ার অনুসারীরা তখন সংগঠিত হচ্ছিল। তাদের দুশ্চিন্তা দ্রুতই সত্য হয়ে গেলো। সামরিক বাহিনীকে মুক্তিযোদ্ধা মুক্ত করতে নানা অজুহাতে একের পর এক ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছিল।
এসব শহীদদের পরিবার তাদের নিকটাত্মীয়দের দেহাবশেষটিও খুঁজে পাননি। ১,০০০ টিরও বেশি বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিবার এখনও দায়মুক্তির সংস্কৃতির অবসানের জন্য বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। তারা মনে করেন, জেনারেল জিয়ার কারণেই ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল।
এর আগে ইন্ডিয়া টুডে-র সাথে একটি সাক্ষাতকারে নিহতদের একজনের ছেলে বলেছিলেন, ‘সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকাররা এক কঠিন জীবনযাপন করেছেন। তাদের পরিবারের সদস্যরা গুমের শিকার হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘আমি এখনও জানি না আমার বাবার দেহাবশেষ কোথায়। আমরা জানি না কেন তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল; আমরা শুধু শুনেছি সেন্ট্রাল জেলে কোনো বিচার ছাড়াই তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। খুনিরা সঠিকভাবে দাফনের মতো কোনো ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের যত্ন নিতেও মাথা ঘামায়নি।’
কর্পোরাল মোবারক আলীর মেয়ে মমতাজ বেগম বলেন, ‘আমার বয়স যখন মাত্র ছয় মাস, তখন জেনারেল জিয়া আমার বাবাকে ফাঁসি দেন। খুনি জেনারেল জিয়া আমাদের জীবনকে ধ্বংস করেছে এবং আমার বাবার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী; কেন তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে সে সম্পর্কে কেউ আমাদের কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।’
জেনারেল জিয়ার ‘সামরিক শাসনের আকাঙ্ক্ষা’
মুক্তিযুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন করা লেখক ও প্রবীণ কলামিস্ট আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক সুখরঞ্জন দাশগুপ্তের মতে, জেনারেল জিয়া সর্বদাই দেশের সামরিক নিয়ন্ত্রণে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য একটি পাকিস্তান-শৈলীর সামরিক শাসনের কল্পনা করেছিলেন।
ইন্ডিয়া টুডেকে দেওয়া একটি সাক্ষাতকারে তিনি এর আগে বলেছিলেন, ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় একজন সিনিয়র বিএসএফ অফিসার তাকে জেনারেল জিয়ার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পর্কে অবহিত করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘটনা নিয়ে ‘মিডনাইট ম্যাসাকার’ নামক বইয়ের এই লেখক বলেন, ‘জাপানসহ বিদেশি শক্তিগুলোর সমস্যা হলো, বিএনপি-জামায়াত জোট বা কামাল হোসেনের গণফোরাম যা কিছু (মিথ্যা) প্রচার করে তা তারা গ্রহণ করে ফেলে। কিছু তথাকথিত অধিকার গোষ্ঠীও এই বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণায় তাদের সাথে যোগ দেয়। যে কারণে এমনকি জাতিসংঘের গুমের তালিকাতেও গুরুতর ত্রুটি রয়েছে। যেমন ভারতীয় বিদ্রোহীদের অনেক আগে ভারতে প্রত্যাবর্তন করা হয়েছিল, সেই নামও তালিকায় আছে।’
সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাস, রক্তের সাগরের মধ্য দিয়ে যেভাবে এর জন্ম হয়েছে ও এর সমসাময়িক ঘটনাবলী এতটাই সুপরিচিত যে বিএনপির মিথ্যার গুঁড়ি তাসের ঘরের মতো পড়ে গেছে।’
জিয়ার ক্ষমতা দখলের ধারাবাহিকতা বজায় রাখে তারেক রহমান
জিয়াউর রহমান যেভাবে উচ্চ সারির সামরিক কর্মকর্তা থেকে সামরিক প্রশাসক এবং সর্বশেষ এক সঙ্গে দেশের সর্বোচ্চ তিনটি পদ দখল করে ক্ষমতা ধরে রেখেছিলো। একই কায়দায় তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি এবং জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ও ছেলে তারেক রহমানও চেষ্টা করেছেন। বেগম জিয়া ১৯৯৬ সালে ভোট কারচুপি করে বেআইনিভাবে মাত্র ৩ মাস ক্ষমতায় থাকতে পেরেছিলেন। আর ২০০১ সালে প্রায় দেড় কোটি ভুয়া ভোটার তৈরি করে নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ব্যবহার করে ভোটে জয়ের বিষয়টিও খুব একটা অজানা নয়। সবচাইতে বড় বিষয় হলো, তারেক রহমান ২০০১-০৬ সালে জিয়াউর রহমানের মতই হত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে বাংলাদেশের ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার চেষ্টা করেন। এ সময় প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সকল পদে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা তৈরি করেন তিনি। দুর্নীতির দায়ে কারাদণ্ড প্রাপ্ত পলাতক আসামী তারেক রহমান প্রসঙ্গে এফবিআই, উইকিলিকস-এর ফাঁস হওয়া প্রতিবেদন সহ আন্তর্জাতিক আরও বেশ কিছু স্থানে তথ্য পাওয়া যায়। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দেয়া তথ্য অনুসারে বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে অর্থ পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত রয়েছেন তারেক রহমান ও তার বন্ধু মামুন।
একাত্তর/এসি
মন্তব্য
এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.