ঢাকা ৩১ মে ২০২৩, ১৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০

নির্মাণের আগেই বিলীন বেড়িবাঁধ, ভেসে গেছে ২২০ কোটি টাকাও

রকিব উদ্দিন পান্নু, একাত্তর
প্রকাশ: ২৪ মার্চ ২০২৩ ২০:০৩:৫০ আপডেট: ২৫ মার্চ ২০২৩ ০০:০২:০৮
 নির্মাণের আগেই বিলীন বেড়িবাঁধ, ভেসে গেছে ২২০ কোটি টাকাও

প্রকল্পের নাম ‘টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ’। তবে, তা এমনই টেকসই যে নির্মাণ শেষের আগেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। নির্মাণের সময়েই এই বাঁধ ভেঙেছে ১১ বার। 

এভাবেই খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালী ও কামারখোলা ইউনিয়নে ২২০ কোটি টাকায় গড়া দুটি বেড়িবাঁধ পানিতে ভেসে গেছে। এজন্য নদীর গতিপথ আর মাটির গঠন নিয়ে গবেষণা ছাড়াই পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্প গ্রহণকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা। 

শিবসা আর ঢাকি নদী যেখানে মিশেছে সেটা জয়নগর গ্রাম। পাখির চোখে দেখলে মনে হবে সদ্য নির্মিত বেড়িবাঁধের মাটি বিশাল কোন দানব খুবলে খুবলে খেয়েছে। কথিত এই টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের সময়ই ভেঙ্গেছে ১১ বার। আর নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে আট বার।

প্রায় একশ বিশ বছর আগে দাকোপের জয়নগর গ্রামে বসতি গেড়ে ছিলেন নকুল চন্দ্র সরকারের পিতামহ গোবিন্দ সরকার। আরও অনেকের মতই জঙ্গল কেটে আবাদ করা ভূমির বাসিন্দাদের বারবার ঘর ভেঙ্গেছে বাঁধ ভাঙ্গনে কবলে পড়ে। ভেঙ্গে যাওয়া বাঁধ আবার নতুনভাবে তৈরি হলেও তারা জানেন, এতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। 

বাঁধ ধসে পড়ার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়মকেই দায়ী করেন নকুল চন্দ্র। তার প্রতিবেশি সুভাষ বলেন, স্থানীয় মাটি এবং নদীর স্রোতের গতিপথকে আমলে নিয়ে কখনোই কোন টেকসই পরিকল্পনা করা হয়নি। যা হচ্ছে সবই লোক দেখানো কমিশন বাণিজ্য। 


স্থানীয় মানুষের মধ্যে কথিত এই টেকসই বেড়িবাঁধের নির্মাণ পদ্ধতি ও পরিকল্পনা নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট ক্ষোভ। ২০১৬ সালে শুরু হওয়া এই টেকসই প্রকল্প শেষ হয়েছে তিন মাস আগে। আগামী বর্ষায় এই বাধ যে পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যাবে তাতে কারোরই সন্দেহ নেই। 

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মাটি পলি সমৃদ্ধ। এই মাটি সহজেই পানিতে গলে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মাটির গঠন নিয়ে গবেষণা করে বেড়িবাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করা হয়নি। বিশ্ব ব্যাংকের অর্থে খুলনার দাকোপ উপজেলায় কামারখোলা ও সুতাখালি ইউনিয়নে ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে টেকসই নামের নতুন বাঁধ, কিন্তু সেটিও নদীতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডে ৩৭ বছর চাকরি করেছেন আব্দুর রব হাওলাদার। সর্বশেষ নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করে এক দশক আগে অবসরে গেছেন। তার মতে এই এলাকার মাটি খনন করে একটু নীচে গেলেই মেলে পিট মাটি। স্থানীয় ভাবে যাকে বলে জোব মাটি, যা গাছপালা পচে তৈরি হয়। এই মাটি দিয়ে তৈরি বাঁধে গর্ত তৈরি হলে সহজেই ভেঙ্গে যায়। 

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি ও পানি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সানাউল ইসলাম দাবি করেছেন, বেড়িবাঁধ নির্মাণের ব্যাপারে কখনো পরামর্শ নেয়া হয়নি স্থানীয় বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। তবে এই বিশেষজ্ঞদের কথা উড়িয়ে দিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী আশরাফুল আলম। বলছেন, প্রকল্প নেয়ার আগে তারা যথাযথ জরিপ করেছেন।


ষাটের দশকে বেড়িবাঁধ নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত থাকা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) প্রকৌশলী জানান, প্রকল্পের শুরুতেই নেদারল্যান্ডের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিলো বাংলাদেশের উপকুলের জন্য এটা কোন টেকসই সমাধান নয়। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন এই বেড়িবাঁধ উপকুল জুড়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসবে। 

সাগরের নোনা পানির প্রবল স্রোত, মাটির আর্দ্রতা ও গঠন নিয়ে কোন ধরনের গবেষণা না করে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এসব বাধ নির্মাণ হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। আর,  পরিবেশবিদদের মতে, এই অঞ্চলে দরকার পলি ব্যবস্থাপনা। তা না করে বাঁধ তৈরি করে সব পলি নদীর বুকেই রেখে দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে আর তাতে নদী তার নাব্য হারিয়েছে। 

আরও পড়ুন: মাল্টা ও খেজুরের সঙ্গে আনারসের দামও বাড়তি

ঝড় বন্যা জলোচ্ছ্বাস আর বেড়িবাঁধের ভাঙ্গনে গেলো বিশ বছরে অন্তত এক লাখ মানুষ দাকোপ এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। গেলও ১৪ বছরে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশের বিভিন্ন উপকুলের বেড়িবাঁধের নির্মাণ,সংস্কারসহ নানা প্রকল্পে খরচ করেছে ৬০ হাজার ৮২ কোটি টাকা। 

যার অর্ধেকই রয়েছে বেড়িবাঁধের খাতে। কিন্তু, দিন শেষে এসব বাধ কাজ লাগছে না সাধারণ মানুষের। এসব বাঁধে তাদের কোন উপকারে না এলেও সরকারের খরচের খাতায় যুক্ত হয় শত শত কোটি টাকা। বাড়তে থাকে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যাও। 


একাত্তর/এসজে

মন্তব্য

এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.

আপনার মন্তব্য লিখুন

Nagad Ads