একের পর এক খুন করে যারা, তাদের বলা হয় সিরিয়াল কিলার। ভয়ঙ্কর সব অপরাধীদের তালিকায় শীর্ষেই থাকে এমন ঘাতকরা। এদের নিয়ে পৃথিবীর সব দেশের কম-বেশি আলোচনা হয়ে থাকে। নির্মাণ করা হয়েছে বহু লোমহর্ষক সিনেমাও।
তেমনই এক সিরিয়াল কিলারের নাম জাভেদ ইকবাল। পাকিস্তানের এক খুনির হাতে বলি হতে হয়েছে অসংখ্য নবালককে। ছয় থেকে ১৬ বছরের বয়সী শতাধিক নাবালককে যৌন নির্যাতন করে খুন করে ফেলার অভিযোগ রয়েছে এই নরপিশাচের বিরুদ্ধে।
নামী পরিবারে জন্ম নেয়া জাভেদ নিজেই স্বীকার করেছেন শতাধিক নাবালককে শ্বাসরোধ করে খুন করার কথা। খুন করার পর প্রমাণ মুছে ফেলতে দেহ টুকরো করে এসিডের মধ্যে ফেলে দিতেন। দোষী প্রমাণিত হওয়ার পর জাভেদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
রায় ঘোষণার সময় বিচারক বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, যেসব বাবা-মায়ের সন্তানকে তুমি হত্যা করে ছিলে, তাদের সামনেই তোমাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হবে। তার পর তোমার শরীরকে ১০০ টুকরো করে এসিডে ছুড়ে ফেলা হবে। ঠিক যেভাবে তুমি ওই নাবালকদের হত্যা করেছিলে।
তবে এই শাস্তি অনুমোদন পায়নি। ফাঁসির রায় কার্যকর করার আগেই ২০০১ সালের ৯ অক্টোবর জাভেদ ও তার সহযোগী সাজিদ আহমদকে কোট লাখপত কারাগারে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বলা হয় দুজনেরই আত্মহত্যা করেছেন। এনিয়ে সেই সময়ে তুমুল সরগোল হয়।
তৈরি হয় ব্যাপক বিতর্কের। অভিযোগ উঠে, কারাগারেই খুন করা হয়েছে জাভেদ এবং তার সহযোগীকে। যদিও কারা কর্তৃপক্ষ জানান, আত্মহত্যা করেছেন জাভেদ এবং তার সহযোগী। জাভেদের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহও নিতে কেউ আসেননি।
জাভেদের জন্ম ১৯৫৬ সালে। এক মুঘল মুসলিম পরিবারে। জাভেদের বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন ষষ্ঠ। জাভেদের বাবা এক জন ব্যবসায়ী ছিলেন। লাহোরের ইসলামিয়া কলেজ থেকে ১৯৭৮ সালে পড়াশোনা করতে তিনি স্টিলের ব্যবসা শুরু করেন।
১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরে লাহোর পুলিশ এবং এক সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদকের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়। জাভেদ ইকবালের পাঠানো সেই চিঠি পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুলিশ এবং ওই সংবাদপত্রের প্রধান সম্পাদক। সেই চিঠিতে একশ নাবালককে হত্যার কথা জানায় জাবেদ।
চিঠিতে জাভেদ দাবি করেন, তিনি যাদের খুন করেছেন তাদের বেশিরভাগই বাড়ি থেকে পালানো এবং লাহোরের রাস্তায় বাস করা নাবালক। তিনি আরও জানান, খুনের পর এসিডে পুড়িয়ে বাকি দেহাবশেষ কাছেই একটি নদীতে ফেলে দেয়া হতো।
এসব নাবালকদের কাছে গেমিং আর্কেড ছিলো ভীষণ জনপ্রিয়। আর জাবেদ ইকবাল সেই ব্যবসা খুলে বসেছিলেন তাদেরকে শিকারের জন্য। কম্পিউটার গেম খেলতে আসার নাবালকদের সঙ্গে তিনি খাতির করতেন তাদের গেম খেলার কয়েন দিয়ে।
জাভেদ আরও জানান, অনেক সময় মাটিতে কয়েন ফেলে রাখতেন তিনি। যে নাবালক কয়েন তুলে নিতো তাকে চুরির দোষে পাকড়াও করে পেছনের একটি ঘরে নিয়ে যৌন নির্যাতন চালিয়ে খুন করতেন। নাবালক শিকারে তাকে বেশ কয়েকজন সাহায্যও করতো।
চিঠি পেয়েই জাভেদের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। কিন্তু পুলিশ আসার আগে পালিয়ে যান তিনি। জাভেদের বাড়ির ভেতরে পুলিশ ও সাংবাদিকরা দেয়াল এবং মেঝেতে রক্তের দাগ দেখতে পায়। সেই অস্ত্রও উদ্ধার হয় যা দিয়ে জাভেদ খুন করতেন।
প্লাস্টিকের ব্যাগে এবং কিছু ডায়েরিতে জাভেদের হাতে খুন হওয়া অনেক নাবালকের ছবি উদ্ধার করে পুলিশ। পাওয়া যায় দেহাবশেষসহ দু’টি এসিডের ট্যাঙ্কও। বেশ কয়েকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কর্তৃপক্ষের হাতে প্রমাণ তুলে দিতেই ইচ্ছা করে সব প্রমাণ প্রকাশ্যে রাখা হয়েছিল।
শুরু হয় জাভেদকে ধরতে শুরু পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্যতম বড় পুলিশি অভিযান। এর মধ্যেই ১৯৯৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর এক সংবাদমাধ্যমের অফিসে গিয়ে দেখা করেন জাভেদ। সেই সূত্র ধরেই এক মাস পর জাবেদকে গ্রেপ্তারে সক্ষম হয় পাকিস্তানের পুলিশ।
ধরা পড়ার পর জাভেদ ইকবাল জানায়, নাবালক হত্যায় তাকে সাহায্য করেছেন অনেকে। সেই সব সহযোগীদের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গ্রেপ্তার হবার পর জাভেদ জানান কি কারণে তিনি একের পর নাবালককে হত্যা করেছিলেন।
নব্বইয়ের দশকে জাভেদের বিরুদ্ধে নিখোঁজ এক নাবালকের উপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগ আনে লাহোর পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত সেই অপরাধ প্রমাণ হয়নি। কিন্তু জাভেদের মা ছেলের গ্রেপ্তারি ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে হার্টঅ্যাটাকে মারা যান।
আরও পড়ুন: আকাশে চন্দ্রবিন্দু, আসলে কী ছিল?
এই ঘটনার পর জাভেদ ইকবাল নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করেন, ১০০ জন মায়ের কোল উজাড় করে তাদের কাঁদতে বাধ্য করবেন তিনি। আর সেই কারণেই তিনি ১০০ নাবালককে অত্যাচার করে খুন করে তাদের দেহ টুকরো করে এসিডে চুবিয়ে নদীতে ফেলে দিতেন।
গেলো বছরই পাকিস্তানে জাভেদ ইকবালের কাহিনী নিয়ে পাকিস্তানে একটি সিনেমা মুক্তি পাবার কথা ছিলো। কিন্তু ‘জাভেদ ইকবাল: দ্য আনটোল্ড স্টোরি অফ এ সিরিয়াল কিলার’ নামে ছবিটির মুক্তি আটকে দেয় পাকিস্তানের একটি আদালত।
একাত্তর/এসি
মন্তব্য
এই নিবন্ধটি জন্য কোন মন্তব্য নেই.