বিভিন্ন জেলায় জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে সাত হাজারের বেশি গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হওয়া খন্দকার আবুল কালাম আজাদকে (৫৩) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গ্রাহকে অর্থ আত্মসাৎ ও প্রতারণার ৬০ মামলার ৩৬টিতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ছিল।
মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) তাকে রাজধানীর কল্যাণপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। সেখানে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
খন্দকার আবুল কালাম আজাদের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার তারাগুনিয়া গ্রামে।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য জানান।
মঈন জানান, ২০০৩ সালে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার খন্দকার আবুল কালাম আজাদ নামের গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি ‘জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি’ নামে প্রতিষ্ঠান চালু করেন। তিনি উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করেন। ২০১৩ সাল থেকে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলায় প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে বড় আকারে ‘জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড’ নামে প্রতিষ্ঠান শুরু করেন।
সম্প্রতি জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির নামে প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল অর্থ হাতিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। এসব জেলার হাজার হাজার সাধারণ মানুষ বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হন। বেশির ভাগ মানুষ তাদের সারাজীবনের কষ্টার্জিত জমানো অর্থ হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েন।
এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেন ভুক্তভোগীরা।
তিনি বলেন, সহজ শর্তে ব্যবসায়ীদের জন্য মোটা অঙ্কের ও প্রান্তিক মানুষের জন্য ক্ষুদ্রঋণ বিতরণের কার্যক্রম শুরু করে। গ্রাহকরা ‘তফসিলি ব্যাংক’ মনে করে তাতে আমানত রাখতে শুরু করেন। অনেক ব্যবসায়ীকে প্রতিষ্ঠান মোটা অঙ্কের ঋণ দেওয়ায় ব্যবসায়ীরা ঝুঁকে পড়েন। বিভিন্ন জেলা শহর গুলোতে দৃষ্টিনন্দন ও নামীদামী বাড়ি ভাড়া নিয়ে চাকচিক্যময় অফিস খুলেন। মূলত পরিবার কেন্দ্রিক ব্যবসা শুরু করে যেখানে তার স্ত্রী, ছোট ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী মিলে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন। এভাবে অল্প সময়ে প্রচুর পরিমাণ অর্থ জামানত হিসেবে গ্রহণ করে আত্মসাৎ করতে সক্ষম হয়।
২০১৭ সালে কুষ্টিয়া, খুলনা, মেহেরপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীসহ প্রতিটি জেলা থেকে অফিস গুটিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান আজাদ। তিনিসহ পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরা সবাই গা ঢাকা দিলে বিষয়টি নিয়ে উক্ত জেলাগুলোতে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।
গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের বরাতে কমান্ডার মঈন বলেন, ২০০৫ সালে মেহেরপুর জেলা শহরের পুরাতন পোস্ট অফিস মোড়ে একটি ভাড়া বাসায় জনতা মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির কার্যক্রম শুরু করেন। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠানের পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে কুষ্টিয়া, খুলনা, মাগুরা, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় জনতা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শাখা চালু করে। যার সভাপতি ছিলেন আবুল হাশেম ও সম্পাদক নাহারুল ইসলাম।
২০১৭ সালে সমিতির গ্রাহক সংখ্যা ৭-৮ হাজার হয় এবং গ্রাহকরা ১০ হাজার থেকে শুরু করে ১৩ লাখ টাকা পর্যন্ত জামানত রাখে। ব্যবসা শুরুর পর থেকে জামানত গ্রহণের পাশাপাশি মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য জামানত প্রদানকারী গ্রাহকদের মুনাফা দেওয়ার কার্যক্রমও চালায়। তবে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়ার আগে আজাদ প্রদান করা অর্থও গুছিয়ে নিতে থাকে।
আরও পড়ুন: ৩ নভেম্বর থেকে ১৪ ডিসেম্বর কোচিং সেন্টার বন্ধ
২০১৭ সালে তার দেওয়া হিসাব মতে, তার নিকট রক্ষিত গ্রাহকদের সঞ্চয়-আমানতের পরিমাণ দাড়ায় প্রায় ৫০-৭০ কোটি টাকা। পরবর্তীতে গ্রাহকদের বিভিন্ন আশা দেখিয়ে তাদের নিকট হতে রক্ষিত সকল জামানতের অর্থ নিয়ে ২০১৭ সালে ঈদুল ফিতরের ছুটিতে আঞ্চলিক সকল অফিস গুটিয়ে নেন। যোগাযোগের সকল ফোন নম্বর একযোগে বন্ধ করে ঢাকার উত্তরায় এসে গা ঢাকা দেন। পালানোর সময় মাঠ পর্যায়ে তার প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ ৩২ লাখ ছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায় আজাদ। যা তিনি আর সংগ্রহ করতে পারেননি।
কমান্ডার মঈন বলেন, মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক ও অর্থ সংগ্রহের জন্য গ্রেপ্তার আজাদের সাথে ৮ শতাধিক কর্মী ছিলেন। যাদেরকে কোনো বেতন দেওয়া হতো না। তাদের গ্রাহকদের বিনিয়োগের মাধ্যমে বার্ষিক ১৮-২০ শতাংশ মুনাফার প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। গ্রাহকদের থেকে উচ্চ মুনাফায় মাসিক ভিত্তিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডিপিএসের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করা হতো।
একাত্তর/এসি