বার্সেলোনা ছাড়া অন্য কোন ক্লাবের জার্সি গায়ে লিওনেল মেসিকে খেলতে দেখা, এক সময় অবাস্তব মনে হলেও, সেটিই এখন সম্ভব হতে চলছে। ছয়বারের বিশ্বসেরা এই তারকা এখন পিএসজির হয়ে গেছেন। দলটির হয়ে এখন শুধু অভিষেকের অপেক্ষা। অপেক্ষায় কাতার ও প্যারিসের। দীর্ঘ এক স্বপ্ন বাস্তবায়নের এমন মুহূর্তের অপেক্ষায় পিএসজি।
যারা ভাবছেন মেসির দলবদল একটি নাটকীয় ঘটনা মাত্র, তাদের জন্য খবর হলো, না কোন নাটক বা দৈব ঘটনা নয়। মেসিকে পেতে দশ বছর ধরে পরিকল্পনা করেছে পিএসজি। আর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে মাত্র একদিনের মধ্যে, অসম্ভব ক্ষিপ্র গতিতে।
৩৪ বছরের মেসি চেয়েছিলেন বার্সেলোনাতেই ক্লাব ফুটবল ক্যারিয়ারের সমাপ্তি টানতে। টানা ২১ বছর একটি ক্লাবের হয়ে খেলার পর খুব কম খেলোয়াড়ই চায় অন্য দলের হয়ে ক্যারিয়ারের ইতি টানতে। কিন্তু বার্সেলোনার অর্থনৈতিক সংকটের বলি হয়ে সেই ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি মেসির।
যেন এমন এক সময়ের অপেক্ষায় ছিলো পিএসজি! বার্সা তরফে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতেই প্যারিসের দলটি অসম্ভব দ্রুতগতি আর পেশাদারিত্বের সঙ্গে মেসিকে নিয়ে আসার জন্য যা যা করার দরকার, তার সবটাই করেছে। পিএসজি সমর্থকদের সামনে মেসিকে হাজির করেছে।
কাতারের ধনকুবের আল খেলাইফি পিএসজিকে কিনে নেওয়ার পর, দলটির শ্লোগান হয়, ‘ড্রিম বিগার’। অর্থাৎ অনেক বড় স্বপ্ন দেখো। ২০১৭ সালে পিএসজি রেকর্ড ২৬২ মিলিয়ন ডলার দিয়ে নেইমারকে বার্সেলোনা থেকে নিয়ে আসার পর ফুটবল বিশ্বের মানচিত্রই বদলে যায়।
অবশ্য এরপরেও পিএসজিকেকে নিয়ে সন্দিহান ছিলো অনেকে। বলা হচ্ছিলো, ওই নেইমার পর্যন্তই। আর কোনো চমক দেখাতে পারবে না দলটি। কিন্তু চার বছরের মধ্যে বিশ্বসেরা ফুটবলারকে দলে ভিড়িয়ে সেই ভুলও ভেঙে দিয়েছে পিএসজি।
২০১১ সালে আল খেলাইফি যখন পিএসজি কিনে নেন, তখন তার একটাই উচ্চাভিলাষ ছিলো, আর সেটি হলো- প্যারিসের দলটিকে ইউরোপের অন্যতম দলে পরিণত করা। তখন দলের অনেক কর্মকর্তাই দাবি করেছিলেন, টাকার গরমে আল খেলাইফিস ইতিহাস ভুলে গেছেন।
নাহ, তিনি ইতিহাস ভুলে যাননি। তার মনে ছিলো নব্বই দশকে পিএসজি ইউরোপে সমীহ জাগানিয়া দল ছিলো এবং ডেভিড জিনোলা ও জর্জ উয়িহ’র মতো তারকা উপহার দিয়েছিলো। তবে এটাও সত্য যে, খেলাইফি যখন দায়িত্ব নিলেন তখন পিএসজির অবস্থা ছিলো খারাপ। কোনো মতে রেলিগেশনের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো দলটি।
সেই অবস্থা থেকে পিএসজি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এমনটা ভাবা ছিলো সত্যিই অসম্ভব। কিন্তু আল খেলাইফি কখন নিরাশ হননি। উল্টো বড় বড় স্বপ্ন দেখেছেন এবং একের পর এক সেসব বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। শুধু মেসিই না, এখন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে আসছেন তিনি।
পিএসজি যখন প্রথমবার মেসিকে পেতে আগ্রহী হলো, তখন বার্সেলোনার সভাপতি বার্তোমেউ এমন এক অংক দাবি করে বসেন, যা পূরণ করা সম্ভব ছিলো না। তখন ভিন্ন রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে পিএসজি। অপেক্ষায় থাকে মেসির সঙ্গে বার্সার চুক্তি নবায়নের সময় পর্যন্ত।
এর ফাঁকে পিএসজির ভেতরে মেসির বন্ধুদের কাজে লাগান আল খেলাইফি। নেইমার, ডি মারিয়া, ইকার্দি, মার্কো ভেরাত্তির মতো তারকারা মেসিকে মন্ত্রণা দিতে থাকেন প্রিন্সেস পার্কে চলে আসার জন্য। আর এসব বিষয় যে ঘটেছিলো এখন তা সবারই জানা।
মেসি দলবদলের আগ্রহের কথা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করলেও, চাইছিলেন শেষ পর্যন্ত দেখার। নতুন চুক্তির সময় ১৪৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণে জর্জরিত বার্সেলোনা কেমন আচরণ করে, সেটিও দেখতে চাইছিলেন তিনি। যা ভেবেছিলেন তাই ঘটেছে। তাকে আর রাখতে চাইলো না বার্সা।
এমন যখন পরিস্থিতি তখন আবারো তৎপর হয়ে উঠেন নেইমার ও ডি মারিয়ারা। বিশেষ করে নেইমার নেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছিলো সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পরা বিভিন্ন ছবিতে। তখন অনেকেই বুঝে যান সামনের দিকগুলোতে কি হতে চলেছে।
শেষ পর্যন্ত গেলো ৪ আগস্ট, বার্সেলোনার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই ডি মারিয়া নিজের ইনস্টাগ্রামে একটি ছবি প্রকাশ করেন, যেখানে পিএসজির চার তারকার সঙ্গে মেসিকে দেখা যাচ্ছে। তখন আর বাকিটুকু বুঝে নিতে বাকি থাকে না।
ডি মারিয়া জানান, তিনি ও পেরেডেস মেসির সঙ্গে ইবিজাতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পরে সেখানে উড়ে আসেন নেইমার। তারপর যোগ দেন ভেরাত্তি। এ সময় তারা মেসিকে আবারো পিএসজিতে আসার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু মেসি রাজি হননি।
কিন্তু সেই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বার্সার ঘোষণা সঙ্গে সঙ্গেই মেসির কাছে প্রস্তাব ও চুক্তিপত্র পৌঁছে দেয় পিএসজি।
আরও পড়ুন: মেসিকে হারিয়ে নতুন রাজা খুঁজছে বার্সেলোনা
ধারণা করা হচ্ছে, সব কাজই গুছিয়েই রেখেছিলেন পিএসজির বস আল খেলাইফি। শুধু অপেক্ষা ছিলো উপযুক্ত সময়ের।
শেষ পর্যন্ত এলো সেই ৫ আগস্ট। ফুটবল ইতিহাসে দিনটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে, কারণ এদিন বার্সোলানা মেসিকে ছেড়ে দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্বান্ত জানিয়ে দেয়। মেসিও নেন সিদ্ধান্ত। তাকে খুঁজে নিতে হয় নতুন ঠিকানা। যার কোন কিছুই সহজ ছিলো না বলে নিজেই জানিয়েছেন মেসি। এরপরের সব ঘটনাই তো এখনো টাটকা। ১০ আগস্ট বার্সার মেসি হয়ে গেলেন পিএসজির।
একাত্তর/আরএ