প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা আবার সন্ত্রাসের যুগে ফিরবেন, না উন্নয়নের পথে থাকবেন।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা সম্ভব ছিলো না জানিয়ে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রকারীরা আবারো আঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
১৮ বছর পরের ২১ আগস্ট। দিনটি এলো এক শোকাবহ আবেগ নিয়ে। যাকে হত্যার উদ্দেশ্যে সেই ভয়াবহ ও নৃশংস গ্রেনেড হামলা হয়েছিলো, সেই তিনি তিন বছর পর ঘটনাস্থলে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্টে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ করতে গিয়ে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এ্যভেন্যুর যে জায়গাতে নিজেই গ্রেনেড হামলার শিকার হয়েছিলেন, সেখানেই হাজির আওয়ামী লীগ নেত্রী।
হামলায় নেতাদের তৈরি মানবঢালে নিজে বাঁচলেও যেখানে আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী মারা গিয়েছিলেন সেই স্থানে শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দু'বছর বাদে প্রিয় নেত্রীকে কাছে পান সেদিন গ্রেনেড হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া নেতাকর্মীরা।
পরে আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া এ জাতীয় ঘটনা ঘটতে পারে না। লক্ষ্য তো ছিল আমাকেই হত্যা করা এবং আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা
শেখ হাসিনা জানান, জাতির পিতাকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি খন্দকার আব্দুর রশীদ ও শরীফুল হক ডালিম ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার সময় বাংলাদেশে অবস্থান করছিলেন।
জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া গ্রেনেড হামলা সম্ভব ছিলো না। জানান, হামলার সময় ঢাকায় ছিলো বঙ্গবন্ধুর খুনি ডালিম আর রাশেদ।
তিনি বলেন, খালেদা জিয়া তাদেরকে যেভাবেই হোক দেশ থেকে চলে যেতে সাহায্য করে। এটা তো বাস্তব কথা। এবং ডালিম যে ঢাকায় ছিল, রশীদ যে ঢাকায় ছিল, এটাতো অনেকেই জানে।
তিনি বলেন, হামলার পরও যখন খুনিরা দেখেল যে তিনি বেঁচে গেছেন, তখন তারা দেশ থেকে পালিয়ে যায়।
শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, এদেরকে কে এনেছিল? বিএনপি সরকারের পক্ষ থেকে যদি ব্যবস্থা না করা হয়, তারা আসলো, আবার তারা চলেও গেল। বিভিন্ন দেশে তারা ফিউজিটিভ হয়ে আছে।
বারবার হামলার শিকার হয়েও প্রাণে বেঁচে যাওয়ার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “আল্লাহ বাঁচায় রাখছেন এদেশের কল্যাণের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য।
এখন রাখে আল্লাহ মারে কে। মারে আল্লাহ রাখে কে। এটাই কথা। আমাকে সেজন্য বারবার বাঁচিয়েছে।
বাংলাদেশের এমন কোনো অঞ্চল নেই যেখানে গিয়ে আমি গুলি, নয় বোমা নয় গাড়ি আক্রমণ- এগুলোর শিকার না হয়েছি। তারপরও বেঁচে আসছি। দেশের কাজ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
সরকারপ্রধান বলেন, আজকে ২১ অগাস্ট। হ্যাঁ, আমাদের যেন নতুন জন্ম হয়েছে, যারা সেদিন ওই র্যালিতে ছিলাম। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব জনগণের প্রতি। আর সেই দায়িত্ব যতক্ষণ নিঃশ্বাস আছে পালন করে যাব। সেটাই হচ্ছে আজকের প্রতিজ্ঞা।
আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খানের সময় এবং একাত্তরেও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ‘নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা’ হয়েছে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগ সভপতি বলেন, এরপর জিয়াউর রহমান এসে চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গুম করতে।
আজকে গুম, খুনের কথা বলে। আমি তো মনে করি আমাদের আওয়ামী লীগের যত নেতাকর্মী ওই জিয়ার আমলে যাদেরকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেনাবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর যত অফিসারকে হত্যা করেছে, সবগুলো সামনে নিয়ে আসা দরকার, যে তারা কী করেছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের উপর ‘নির্মম নির্যাতন’ চালানো হয়েছে হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতেই বিএনপি-জামায়াত তথা চার দলীয় জোট সরকার রাষ্টযন্ত্র ব্যবহার করে নৃশংসতম এই গ্রেনেড হামলা চালায়। যারা গণতন্ত্রের কথা বলে, তাহলে এটা কীসের গণতন্ত্র? একটা প্রকাশ্য জনসভায় কীভাবে আর্জেস গ্রেনেড মারতে পারে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আক্রমণকারীদের রক্ষা করার জন্য সেদিন ভয়াবহতার মধ্যেই পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস ছুড়েছে। সব আলামত সিটি করপোরেশনের গাড়ি দিয়ে ধুয়ে নষ্ট করা হয়েছে।
একটা গ্রেনেড অবিস্ফোরিত থেকে যায়, সেটি সংরক্ষণের কথা বলায় এক অফিসারকে ধমকানো হয়। পরে তাকে নির্যাতনও করা হয়েছে। সরকারের সহযোগিতা না থাকলে এমন হতে পারে না।
তিনি আরও বলেন, এখানে একজন কারারক্ষী জড়িত ছিলো। ওই দিন রাতেই খালেদা জিয়া চার জনকে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে ওই কারারক্ষীও ছিলেন।
২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার মত ঘটনা আগামীতেও ঘটতে পারে মন্তব্য করে দেশের মানুষকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, এই আঘাত হয়ত আরো আসবে সামনে। কারণ যখন আমার আব্বা দেশ উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো, তখনই তো ১৫ অগাস্ট ঘটেছে। আর আজকেও বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে, উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার ভাষায়, স্বাধীনতার চেতনায় আবার সেই 'জয় বাংলা' ফিরে এসেছে, আবার জাতির পিতার নাম বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হচ্ছে, এগুলো যারা সহ্য করতে পারবে না, তারা বসে থাকবে না। তারা আঘাত করবেই। বাংলাদেশকে আবারও সেই জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করবে।
বিএনপির সঙ্গে সমঝোতায় বিভিন্ন গোষ্ঠী সরকারকে চাপ দিচ্ছে-এমন ইঙ্গিত করে সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, এখন তাদের সঙ্গে বসতে হবে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাদের খাতির করতে হবে। তাদের ইলেকশনে আনতে হবে। এত আহ্লাদ কেন, আমি তো বুঝি না।
বাংলাদেশে কি আর মানুষ নেই? বিদেশিদের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করে। সেখানে থেকে এসে রিকোয়েস্ট করে, কোনোমতে তাদের একটু জায়গা দেওয়া যায় কি না?
জায়গা দেবে কি না, সেটা ভাববে জনগণ। সে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশের জনগণ। তারা আবার সেই সন্ত্রাসের যুগে ফেরত যাবে, নাকি আজকে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন হচ্ছে, সেই উন্নয়নের যুগে থাকবে, এ সিদ্ধান্ত তো জনগণকে নিতে হবে।
আওয়ামী লীগ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা তো জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছি। কেউ যদি ইলেকশন করে; ইলেকশন করবে কীভাবে?
যে দলের নেতাই নেই, সাজাপ্রাপ্ত অথবা পলাতক, তারা ইলেকশন করবে কী, আর কীভাবে ভোট পাবে? ভোট কাকে দেখে দেবে-এটাই তো প্রশ্ন।
তারপরও অনেক চক্রান্ত আছে। এখনো যেমন নানা রকমের চক্রান্ত। ইলেকশন সামনে এলেই শুরু হয়। কিন্তু এ দেশের মানুষের ওপর আমার আস্থা আছে। বিশ্বাস আছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সঙ্গে বিএনপি নেত্রীর জড়িত থাকার কথা জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়ার বক্তৃতাগুলো অনুসরণ করবেন।
কোটালীপাড়া বোমা পুঁতে রাখার আগে বলেছিল, আওয়ামী লীগ শত বছরেও ক্ষমতায় আসতে পারবে না। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আগে-শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা, বিরোধী দলের নেতাও কোনো দিন হতে পারবে না। এগুলোর তো রেকর্ড আছে।
এই বক্তৃতা আগাম দিলো কীভাবে যে বিরোধীদলের নেতা হতে পারব না। তার মানে আমাকে হত্যা করবে-এ পরিকল্পনা তারা নিয়ে ফেলেছে।
২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরে সংসদে আওয়ামী লীগকে তৎকালীন বিএনপি সরকার কথা বলতে দেয়নি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া সেখানে বলে দিল, ওনাকে আবার কে মারতে যাবে? উনি তো নিজেই গ্রেনেড নিয়ে গেছেন! নিজেই গ্রেনেড হামলা করেছেন! মানে আমি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম। এটাই হচ্ছে তাদের কথা।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে দলের নেতা-কর্মীসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শেখ হাসিনাসহ দলের কয়েকশ’ নেতা-কর্মী।
সেই কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, যারা স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে আছে, প্রত্যেকেই কিন্তু কষ্ট ভোগ করছে। যত বয়স বাড়ছে, ততই তাদের শরীরের যন্ত্রণা বাড়ছে। আমি সকলের খোঁজ রাখি। বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে তাদের সাহায্য করি। আমার যতদূর সাধ্য, করে দিয়েছে।
আমি কাউকে ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছি। কাউকে জমি কিনেছি। ঘর করে দিয়েছি। মাসোহারার ব্যবস্থা করে দিয়েছ। প্রতি মাসে ওষুধ কেনার টাকা দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু তারা যা হারিয়েছে, সেটা তো ফেরত দিতে পারব না। তাদের শরীরের যন্ত্রণা তো প্রশমন করতে পারব না।
আওয়ামী লীগ প্রতিশোধের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে না-এমনটি জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, এই যে কষ্টগুলো নিয়ে মানুষ বেঁচে আছে, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বারবার আঘাতের শিকার হচ্ছে, কিন্তু আমরা সরকারে এসে তো রিভেঞ্জ নিতে যাইনি। আমরা তো ওদের ঘরবাড়ি দখল করতে যাইনি। হাতুড়ি দিয়েও পিটিয়ে মারিনি। কারাগারেও রাখিনি। কিছুই করিনি।
ভাষণের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী ২১ আগস্ট নিহত নেতা–কর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলেন। বক্তৃতার সময় তিনি কয়েকবার আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।
একাত্তর/এসএ