২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ চলাকালে সংঘটিত ভয়াবহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রোববার (১ জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হলো আলোচিত মামলা ‘চিফ প্রসিকিউটর বনাম শেখ হাসিনা গং’। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগ আমলে নিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। মামলার অপর দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
মামলার প্রথম দিনেই চিফ প্রসিকিউটর মুহাম্মদ তাজুল ইসলাম আদালতে তার সূচনা বক্তব্য রাখেন। একাত্তরের পাঠকদের জন্য তার সূচনা বক্তব্য হুবহু প্রকাশ করা হলো:
'মাননীয় বিচারক বৃন্দ, আজ ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় মুহূর্তে এই ট্রাইবুনালের এই পবিত্র কক্ষে দাঁড়িয়ে , আমি শুধু একজন আইনজীবীই নই, ইতিহাসের এক তাজা রক্তাক্ত অধ্যায়ের সশ্রদ্ধ ভাষ্যকার।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের নারকীয় বীভৎসতা বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেককে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার উদগ্র বাসনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক ও পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণের মাধ্যমে সংঘটিত নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ ও সহিংসতা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল ৫৬ হাজার বর্গমাইল বিস্তৃত একটি বধ্যভূমিতে।
আমরা এই বিচার শুরু করেছি জাতির ইতিহাসের সেই বেদনাদায়ক অধ্যায়ে সংঘটিত অপরাধের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে - যেখানে নিরস্ত্র , নিরীহ সাধারণ নাগরিক, বিশেষ করে তরুণ ছাত্র-যুবা, নারী ও শিশু - যারা একটি ন্যায় ভিত্তিক ভবিষ্যতের জন্য বৈষম্য ও কোটা পদ্ধতি নামক কু-প্রথার অবসানের দাবিতে অহিংস ও ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল।
২৪ এর এই আন্দোলনে বৈষম্য বিরোধী ও সরকারের সাথে ভিন্নমত পোষণকারী অসংখ্য নিরীহ,নিরস্ত্র ও সাধারণ মানুষ এই মামলার অভিযুক্ত আসামিগণ কর্তৃক নির্বিচার হত্যাকাণ্ড ও ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হন। আসামিদের নির্দেশে ও তাদের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের দ্বারা সংঘটিত হয় হত্যা, অঙ্গহানি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, গুম, চিকিৎসা প্রদানে বাধা এবং মৃত ও জীবিত মানুষকে একত্রে পুড়িয়ে দেয়ার মত ঘৃণ্য মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো ।
মাননীয় আদালত,
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব যা ‘মনসুন রেভুল্যুশন’ বা ‘বর্ষা বিপ্লব’ নামেও পরিচিত-সংঘটিত হয়েছিল দেড় দশক ধরে চলমান রাজনৈতিক নিপীড়ন,মানবাধিকার হরণ ও রাজনৈতিক উগ্রপন্থার মাধ্যমে সৃষ্ট গভীর সামাজিক বিভাজনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। ২০২৪ সালের পহেলা জুলাই থেকে ৫ ই আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আসামিগণের নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বৈধ চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়া তরুণদের অবিস্মরণীয় জাগরণ নির্মূল করার উদ্দেশ্যে আসামিগণ সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ওই সব মুক্তিকামী ছাত্র-জনতাকে নির্মূল বা স্তব্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ব্যাপকভিত্তিক এবং পদ্ধতিগত আক্রমণ চালায়।
উপস্থাপিত সাক্ষ্য প্রমাণ এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায় - এটি ছিল একটি Coordinated Extermination Plan , যা ছিল Widespread এবং Systematic। রাষ্ট্রের প্রশাসন যন্ত্র ,পুলিশ ,গোয়েন্দা সংস্থা ,অন্যান্য বাহিনী সমূহ এবং সরকারি দলের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের অধীনস্থ সশস্ত্র রাজনৈতিক গোষ্ঠী সমূহ এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনে অংশগ্রহণ করে।
মাননীয় আদালত
এই বিচার শুধু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ই নয় বরং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ “আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন” , “রোম স্ট্যাটিউট অফ দি আইসিসি” এবং বাংলাদেশের ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইন অনুসারেও বিচারযোগ্য।
এই ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আমরা যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করব সেগুলো হচ্ছে:
১। প্রত্যক্ষদর্শী ও জীবিত ভিক্টিমদের সাক্ষ্য
২। অপরাধ সংগঠনের সময় ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ
৩। ড্রোন এবং সিসিটিভি ফুটেজ
৪। আসামিগনের মধ্যে টেলিফোন সংলাপের অডিও ক্লিপস
৫। ডিজিটাল এভিডেন্স সমূহের ফরেন্সিক রিপোর্ট
৬। আসামিগণের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি
৭। গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত তথ্য ,ছবি এবং ভিডিও
৮। জাতীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের প্রস্তুতকৃত রিপোর্ট
৯। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রাপ্ত অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ইত্যাদি
মাননীয় আদালত
এই বিচার কেবল অতীতের প্রতিশোধ নয়। এটি ভবিষ্যতের জন্য প্রতিজ্ঞা ।
আমরা প্রমাণ করতে চাই একটি সভ্য সমাজ , যেখানে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন থাকবে - সেখানে গণহত্যা কিংবা মানবতা বিরোধী অপরাধ সহ্য করা হবে না ।
যে দেশে বিচার থাকবে সেখানে কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে পারে না , কেউ আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না।
মাননীয় আদালত
বিচার শুরুর এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমি শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি জুলাই বিপ্লবের সেই সব ভিকটিমদের যারা আর কোনোদিন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসবেনা।স্মরণ করছি তাদেরকেও - যারা এই আন্দোলনে চোখ,হাত, পা কিংবা শরীরের অন্য কোন অঙ্গ হারিয়েছেন। স্মরণ করছি সেই সব অকুতোভয় মানুষদের, যাদের অপরিসীম ত্যাগের কারণে এই রাষ্ট্র অন্ধকার সময় পেরিয়ে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছে।
এই আদালত এমন একটি সময়ের সাক্ষ্য বহন করছে - যা ইতিহাসের এক অনন্য দলিল হয়ে থাকবে । আমরা চাই এ বিচার হোক নিরপেক্ষ , প্রমাণ নির্ভর এবং ন্যায় ভিত্তিক । আমরা চাই এ বিচার শুধু বাংলাদেশের সামাজিক জীবনে সৃষ্ট গভীর ক্ষত মুছে না দিক , বরং এটি হোক এক আত্মাভিমানী জাতির ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণ।'