গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে ভারত দখলের অভিযানে বাংলার মানুষের গঠন, চালচলন, কৃষ্টি, সভ্যতা... ইত্যাদির ভিন্নতা ও বিচিত্রতা দেখে অবাক ও বিস্মিত হন এবং এ এলাকা আক্রমণ না করে ফিরে যান। এই বৈচিত্র্য দেখে আলেকজান্ডারের অনুভূতি দিজেন্দ্রলাল রায় তার একটি লেখায় তুলে ধরেন, ‘সত্যিই সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!’ - কালের বিবর্তনে অবাস্তব, অসম্ভব, অসহনীয় বা আজগুবি অবস্থার উদ্ভব বুঝাতে বাক্যটির বেশী ব্যবহার দেখা যায়।
সম্প্রতি জাতিসংঘকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সম্পর্কে কয়েকটি দেশীয় মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদন মনে করিয়ে দিয়েছে “সত্যি সেলুকাস! যেন এদেশে যা খুশি প্রকাশ করা যায়, যা খুশি দেখানো যায়।” আর তাইতো কিছু কিছু পত্রিকা বা টেলিভিশনের নিউজ দেখলে মনে হবে দেশের অবস্থা ভয়াবহ। প্রশ্ন আসবে, আমরা সকলে যা চোখে দেখছি বা শুনছি তারা কি সব প্রকাশ করছে? কেও বা বলবে হ্যাঁ; আবার কেও বা বলবে না! কার কথা বিশ্বাস করবো?? এক্ষেত্রে সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি হচ্ছে মূল উৎসের সন্ধান করা। সত্য উদঘাটন করা।
“বাংলাদেশে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিপজ্জনক অবক্ষয় ঘটেছে: জাতিসংঘ”- শিরোনামে একাধিক জাতীয় দৈনিকে গত ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন। হঠাৎ করে এই হেডলাইনটি দেখলে আঁতকে উঠতে হবে, যেমন আমি উঠেছিলাম! আর এই শিরোনামে আকর্ষিত হয়ে ১ম অনুচ্ছেদটির পড়লে গভীর নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে, কেননা এখানে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশে মানবাধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের বিপজ্জনক অবক্ষয় ঘটেছে। সেই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি জনগণের আস্থা নষ্ট হওয়ার কারণে আমরা শঙ্কিত। এটি দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ করছে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিপন্ন করতে পারে বলে বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ।
আমার মতো যারা নিয়মিত পত্রিকা পড়েন, অনেকের কাছেই এই প্রতিবেদনটি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জন্ম দিবে। মাত্র ৫ দিনে পৃথিবীতে এমন কি ঘটেছে, বা জাতিসংঘে কি কোন ক্যু হয়েছে? কেন বললাম! এটাই তো বলা স্বাভাবিক, কেননা মাত্র ৫ দিনের মধ্যে জাতিসংঘের বাংলাদেশ সম্পর্কে অবস্থান ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলো? আর এই যাদু কে দেখালো? এর পিছনে রহস্যটাই বা কি?
এবার ছুটি রহস্যের পেছনে। দেখি কি পাওয়া যায়? কেননা গত ২০ জানুয়ারি ২০২৪ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস আবারও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণে শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চান। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি লেখেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে জাতিসংঘের কান্ট্রি টিমের (বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের কর্মী) মাধ্যমে আপনার সরকারের সঙ্গে কাজ করতে জাতিসংঘ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ...জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বড় অবদান, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি উদারতা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে প্রচেষ্টাসহ বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্বকে জাতিসংঘ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে।
জাতিসংঘ মহাসচিব আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আরও বলেন, গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপে আপনার অংশগ্রহণের প্রশংসা করছি। আমি বিশ্বাস করি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই ও জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক আর্থিক কাঠামো সংস্কারের প্রয়োজনীয়তাসহ ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মতো যেসব উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য আমরা নিয়েছি, সেসব বিষয়ে আগের মতো আপনার অব্যাহত সমর্থন আমরা পাব।
মহাসচিবের এই ইতিবাচক বিবৃতির পাঁচ দিন পরে কি এমন ঘটল যে জাতিসংঘ বাংলাদেশের মানবাধিকার ও আইনের শাসনের বিপজ্জনক অবক্ষয় দেখে ফেললো, আর এ নিয়ে প্রেস নোট জারি করল? চিন্তনীয় বটে? আসল নিউজটা কী?
গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৪ তারিখ জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) ওয়েবসাইটে ‘বাংলাদেশ: সরকারকে তার চতুর্থ মেয়াদে মানবাধিকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে’ শিরোনামে র্যাপোটিয়ার বা বিশেষজ্ঞদের বিবৃতি হিসেবে একটি প্রেস রিলিজ । বিশেষ পদ্ধতি (PRESS RELEASES / SPECIAL PROCEDURES) হিসেবে প্রকাশিত হলো, যাকে আমাদের মিডিয়া জাতিসংঘের অফিশিয়াল বিবৃতি হিসেবে লিখে দিল!
এখন বুঝতে হবে, স্পেশাল প্রসিডিউরস আসলে কি, আর এই জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞরাই বা কারা এবং তারা কি কাজ করেন। এই প্রেস রিলিজ তৈরিতে Special Rapporteurs, Independent Experts and Working Groups এর মোট নয়জন সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এটা কোন বিধিবদ্ধ প্রতিবেদনের অংশ নয় কিংবা কোন ইম্পিরিক্যাল গবেষণা ভিত্তিকও নয় বা কোন বিধিবদ্ধ বডিতে আলোচনার মাধ্যমে পাশ হওয়া কোন রেজ্যুলেশনও নয়, এটা হলো জাস্ট কয়েকজন ব্যক্তির নিজস্ব ব্যক্তিগত মতামত।
সত্যিই সেলুকাস! এই প্রেস রিলিজের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের একাধিক শীর্ষস্থানীয় দৈনিক না বুঝেই ২৫ জানুয়ারি ২০২৪ ডেস্ক প্রতিবেদন হিসেবে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘ কর্তৃক নেতিবাচক অবস্থা প্রকাশ করে দিলো। যা পড়ে যে কেউই মনে করবে এটা হয়তো বাংলাদেশের বিপক্ষে জাতিসংঘ বা তার মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থার অফিশিয়াল প্রাতিষ্ঠানিক বিবৃতি। আসলে তা নয়।
স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার্স এবং স্বাধীন বিশেষজ্ঞগণ মানবাধিকার কাউন্সিলের স্পেশাল প্রসিডিউর্সের অংশ। স্পেশাল প্রসিডিউর, জাতিসংঘের মানবাধিকার ব্যবস্থাপনার স্বাধীন বিশেষজ্ঞগণের বৃহত্তম অংশ যা কাউন্সিলের দেশভিত্তিক বা ইস্যুভিত্তিক মানবাধিকার বিষয়ে স্বাধীন তথ্যানুসন্ধান ও তদারকি করে থাকেন।
স্পেশাল প্রসিডিউর স্বেচ্ছাভিত্তিক, তাঁরা জাতিসংঘের স্টাফ নন এবং তাঁদের কাজের জন্য কোন বেতন নেন না। তাঁরা কোন সরকার বা সংগঠনের অংশ নন এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের পর্যবেক্ষণ মানবাধিকার কাউন্সিল বা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ সভায় রেজুলেশন আকারে গৃহীত না হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তা গুরুত্বপূর্ণ বা অবশ্য পালনীয় নয় বা সর্বজন গ্রহণযোগ্যও নয়।
এই বিবৃতিতে স্পষ্টতই কনটেক্সট সম্পর্কে জ্ঞানীয় সীমাবদ্ধতা পরিলক্ষিত হয়েছে, কেননা এই বিশেষজ্ঞদের বিবৃতিতে দাবী করা হয়েছে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত, প্রায় ২৫ হাজার বিরোধী নেতা (!) ও সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এবং রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য কথিত নির্যাতন এবং ইচ্ছাকৃতভাবে স্বাস্থ্যসেবা অস্বীকার, আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের অত্যধিক শক্তি প্রয়োগ, অগ্নিসংযোগ, সহ নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় ৫৬ জন নিহতের কথা বলা হয়েছে।
অপরদিকে ভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে জাতিসংঘ সনদ লঙ্ঘন করে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের একটি প্রয়াস দেখা গেছে। এতে অজ্ঞাত গোষ্ঠীর সহিংসতা সম্পর্কে ইংগিত দেওয়া হলেও বিএনপি-জামাতের অগ্নিসন্ত্রাস ও মানুষ হত্যার বিষয় তুলে না ধরে অপরাধীদের রাজনৈতিক কর্মী হিসবে দেখাতে চেষ্টা করা হয়েছে।
আসলে এটা ভুললে চলবে না যে, সন্ত্রাসীরা বিশ্বে কোথাও কোন রাজনৈতিক দলের নয়। তারা প্রকৃতপক্ষেই মানবাধিকারের জন্য বড় হুমকি। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে ইংরেজিতে প্রকাশিত স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের মাত্র ৪৮৪ শব্দের এই সাধারণ প্রেস বিবৃতির শেষ অনুচ্ছেদে আসল অভিপ্রায় বা ইনটেনশন ফুটে ওঠেছে, যাতে তাঁরা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করে বলেছেন, আমরা মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে শক্তিশালী করার জন্য এই এবং অন্যান্য পদক্ষেপের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে সমর্থন ও পরামর্শ দিতে প্রস্তুত।
এই প্রেস রিলিজটি হচ্ছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত অনেকগুলো বিষয়ভিত্তিক গ্রুপের মধ্যে একটি গ্রুপের। এই বিবৃতিটি কিছুটা নেতিবাচক হলেও, ইউএনসিএইচআরের এই একই ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত অন্য কয়েকটি গ্রুপের বিশেষজ্ঞদের প্রেস রিলিজ-বিবৃতি বা প্রতিবেদনে ইতিবাচক প্রশংসা দেখা যায়। যেমন: দি ডেইলি স্টার গত জানুয়ারি ১৬, ২০২৩ তারিখে এরকম আরেকটি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের স্পেশাল প্রসিডিউরস প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে দেখা যায়, প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘের অভিবাসী মানবাধিকার বিষয়ক স্পেশাল র্যাপোর্টিয়ার ফেলিপে গনজালেয মোরালেস।
জাতিসংঘের এই বিশেষজ্ঞ বিশেষভাবে, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মৌলিক সুযোগ-সুবিধাসহ জোর করে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভব দৃষ্টান্তের প্রশংসা করেন। তিনি অভিবাসীদের অধিকার সুরক্ষায় গৃহীত 'গ্লোবাল কম্প্যাক্ট অন মাইগ্রেশন' প্রণয়ন ও নেগোসিয়েশনে বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্রের নীতিগুলো ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অবিচল বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত মানবতার পক্ষে সবসময়ই সোচ্চার। ১৯৭১ সালে এ দেশের জনগণ নিজেরাই ভয়াবহ গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হয়েছেন।
দেশের মিডিয়াকে আহ্বান জানাই, কোন অপশক্তির ইন্ধনে যে কোন ধরণের সংবাদ গুরুত্বের সাথে প্রচারের আগে নৈতিক মানদণ্ডে বিচার করুণ। মনে রাখতে হবে আমাদের মানবাধিকার অনেকের চেয়েই ভালো। আর আমদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যদি সত্যিই খারাপ হতো, তাহলে কি জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের (ইউএনএইচআরসি) নির্বাচনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ভোটে সদস্য নির্বাচিত হতে পারতো? (২০২৩-২০২৫ মেয়াদের জন্য, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অনুষ্ঠিত এই নির্বাচনে ১৮৯টির মধ্যে রেকর্ড ১৬০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত বাংলাদেশ)।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের এই ফল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মানবাধিকারের প্রচার ও সুরক্ষায় বাংলাদেশের অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং অঙ্গীকারের আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের স্বীকৃতির সুস্পষ্ট বহিঃপ্রকাশ। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে নেতিবাচকভাবে চিত্রিত করার লক্ষ্যে দেশে এবং বিদেশে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত কতিপয় ব্যক্তিবর্গের দ্বারা মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে চলমান স্মারক প্রচারণাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে, যদি প্রকৃতপক্ষেই আমরা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে চাই।
লেখক: অধ্যাপক, শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।