প্রায় তিন দশক পর আবারো আলোচনায় ওঠে আসলো মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ। দ্বিতীয় বিয়ে করার অপরাধে ১৯৯৩ সালের ১০ জানুয়ারি গ্রাম্য ফতোয়াজরা সালিশ ডেকে কমলগঞ্জের ছাতকছড়া গ্রামের নূরজাহানকে মধ্যযুগীয় কায়দায় পাথর ছুড়ে। গ্রাম্য সালিশ ও ফতোয়াবাজদের এই অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন নূরজাহান।
নূরজাহান হত্যাকাণ্ডের প্রায় তিন দশক পর এবার অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছে কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা বাগানের ১৩-১৪ বছর বয়সী প্রীতি উরাং। তার মৃত্যুর ঘটনাটি চা বাগানের কোনো সবুজ ঘেরা স্থানে নয়, একেবারে আলোঝলমল নগরী রাজধানী ঢাকার একটি অভিজাত ভবন থেকে ‘পড়ে গিয়ে’! যেখানে প্রীতি শিশু বয়সেই নিজের ও পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তনের অনেক স্বপ্ন নিয়ে কাজ করতে এসেছিল।
অভিযোগ ওঠেছে, প্রীতিকে নয় তলা থেকে নিচে ফেলে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। এলাকাবাসীর বিক্ষোভের মুখে পুলিশ প্রীতির গৃহকর্তা সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকারকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। আশফাকুল হক দেশের প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক। প্রীতির এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনার পর থেকে তারা দুই জনই কারাগারে রয়েছেন। মামলা হয়েছে অবহেলাজনিত মৃত্যুর দায়ে।
এসব বিষয় আমার আলোচনার উপজিব্য নয়। মামলা যেহেতু হয়েছে অবশ্যই আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। আমার আলোচনার বিষয় হচ্ছে ক্ষুদে প্রীতি কিভাবে ঢাকা পর্যন্ত আসলো? কে বা কারা তাকে এই পর্যন্ত নিয়ে এসে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিলো? তার জীবনকে শুরুতেই থামিয়ে দিলো?
প্রীতি উরাং এর বয়স মাত্র ১৩ কি ১৪ বছর। কমলগঞ্জের মিরতিংগা চা বাগানের একেবারেই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। পিতা লোকেশ উরাং, মা নমিতা উড়াং। তারা চা শ্রমিক হলেও নিয়মিত শ্রমিক নয়। বছরে তিন থেকে চার মাস অর্থাৎ চা পাতা কুড়ানোর সময়টাতে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। বাকি ৮ মাস তাদের কোনো কাজ থাকে না। বাগান থেকে কাঠ কুড়িয়ে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালান লোকেশ ও নমিতা। ফলে পরিবারটিতে দারিদ্র্যতা লেগে থাকে নিত্য।
তাদেরকে এই দারিদ্যতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হয় সারাবছর। একটু ভালো থাকার আশায় এবং মেয়ে যাতে একটু ভালো খেতে পারে, জামাকাপড় পরতে পারে, তার আয় দিয়ে সংসারেও একটু স্বচ্ছলতা আসতে পারে সেই আশায় প্রীতিকে তুলে দিয়েছিলেন মামা ফুলসাই উরাং এর হাতে। তিনিই তাকে ঢাকায় পাঠানো উদ্যোগ নেন। ফুলসাই উরাং এর কাছ থেকে প্রীতিকে ঢাকায় পৌঁছে দেওয়ার কাজটুকু করেছেন মিন্টু দেশওয়াল। যা প্রীতির মা-বাবা জানতেন না। মৃত্যুর পরই তারা জানতে পারেন প্রীতি ঢাকায় থাকতো।
ইংরেজি দৈনিক ডেইলী স্টারের মৌলভীবাজার প্রতিনিধি মিন্টু নিজের বস-এর বাসায় পাঠিয়েছিলেন প্রীতিকে। আইন অনুযায়ি আমাদের দেশে ১৮ বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু। আর প্রীতির বয়স তো মাত্র ১৩ কি ১৪ বছর। এই বয়সে তার লেখাপাড়া করার কথা, গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হই-হুল্লুড় করে ছুটে বেড়ানোর কথা। পাড়ার অন্য শিশুদের সঙ্গে কিংবা বিদ্যালয়ের সহপাঠিদের সঙ্গে পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায় মগ্ন থাকার কথা। চা বাগানের লাইনে লাইনে চষে বেড়ানোর বয়সেই প্রীতি এখন দূর আকাশের তারা।
যতদূর জানি, বাংলাদেশের যেসব পত্র-পত্রিকা শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে সোচ্চার, যারা শিশুশ্রম বন্ধে নিজেদের পত্রিকায় সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ করেন নিয়মিত সেই রকমই একটি দায়িত্বশীল পত্রিকা হচ্ছে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার। পত্রিকাটির দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি হচ্ছেন অভিযুক্ত এই নির্বাহী সম্পাদক। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে দিনরাত সোচ্চার থাকা ব্যক্তিটি কিভাবে তার বাসায় শিশু শ্রম পারমিট করলেন? আমার প্রশ্নটা সেই জায়গায়।
তার বাসায় যে এই প্রথম কোনো শিশু-শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছে তা কিন্তু নয়, এর আগেও কাজের লোক হিসেবে আরেকটি শিশু কাজ করেছে। ওই শিশুটিও একইভাবে তার বাসা থেকে নিচে লাফ দিয়ে ছিল। সে প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রীতির শেষ রক্ষা হয়নি। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
শিশু শ্রম নিয়ে শুধু বড় বড় পত্রিকাগুলোই নয়, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, নারী সংগঠ, শিশু অধিকার কর্মীরা কাজ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রীতির মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে কাউকে কথা বলা তো দূরের কথা বিবৃতি পর্যন্ত দিতে দেখলাম না!
তার কারণ কী? প্রীতি দরিদ্র চা-শ্রমিকের মেয়ে? প্রীতি শিশু শ্রমিকের মধ্যে পড়ে না? না- কি প্রভাবশালী ব্যক্তির বাসার কাজের লোক হওয়ার কারণে প্রীতির বিষয়ে সবার মুখে কুলুপ দেওয়া? যদি তাই না হয়ে থাকে তাহলে কেন কেউ কথা বলছেন না, এটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
এ থেকে এটা ধারণা করা কি খুব বেশি অপরাধ হবে যে, প্রীতিরা শহরের মানবাধিকারকর্মী, শিশু অধিকারকর্মী, নারী নেত্রীদের কাছে মানুষ হিসেবে গণ্য হয় না।
তবে জন্মমাটি বলে একটা কথা আছে। কেউ কথা না বললেও নিজের ভূমি কথা বলতে ভুল করে না। প্রীতির উরাং এর জন্য রাজপথে দাঁড়িয়েছেন মৌলভীবাজারের চা-শ্রমিক থেকে শুরু করে সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদসহ সচেতন জনগোষ্ঠী।
গত রোববার মৌলভীবাজার শহরের চৌমুহনায় তারা মানববন্ধন করেছেন। সেখান থেকে তারা অভিযোগ করেছেন, শিশু প্রীতিকে হত্যা করা হয়েছে। তাদের এই অভিযোগ অবশ্যই আমলযোগ্য। কারণ, এর আগেও একই বাসা থেকে আরেক শিশু নিচে লাফ দিয়েছিল।
মৌলভীবাজারের মানবন্ধন থেকে প্রীতি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের ন্যায় বিচার দাবি করা হয়েছে। আমিও মৌলভীবাজারের মানবন্ধনের সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে বলতে চাই, প্রীতির মৃত্যু ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হোক। যাতে ভবিষ্যতে আর কোনো প্রীতিকে এমন মৃত্যুর মুখোমুখি হতে না হয়।
লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।