চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে পাগলা নদীর ওপর বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মইন উদ্দিন আহমদ মুন্টু সেতুর নির্মাণ কাজ জমি অধিগ্রহণসহ নানা জটিলতায় থমকে আছে। কাজ শুরুর দেড় বছরে অন্তত তিন বার বন্ধ হয়েছে সেতুটির নির্মাণ কাজ। এতে উপজেলার তিন ইউনিয়নের মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেতুর দুই দিকে প্রায় ৩৫টি বাড়ি দীর্ঘ দিনেও উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় নির্মাণকাজ বিঘ্নিত হচ্ছে। গত দেড় বছরে তিন বছর মেয়াদি এ সেতুর কাজ হয়েছে মাত্র ৪৫ ভাগ। তবে তাদের দাবি, আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
এলজিইডি সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ১৪ নভেম্বর শেষ হওয়ার কথা। ১৭২.৩০০ মিটার সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৯ কোটি ৯৮ লাখ ৭৭ হাজার ৩১৫ টাকা।
সরেজমিন, শুরুর দেড় বছরে মাত্র দুটি পাইলিংয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ আগাচ্ছে খুব ধীরগতিতে। বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শুরুর দিকেই নির্মাণে অনিয়ম হওয়ায় এলাকাবাসী বাধা দিয়েছিলেন। পরে তদন্ত করে অনিয়ম দূর করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় নির্মাণ অতিবৃষ্টি এবং বন্যার কারণে বন্ধ ছিল। বর্তমানে বন্ধ আছে জমি অধিগ্রহণ জটিলতায়। এতে দীর্ঘদিন ধরে খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সরঞ্জামাদি, সে ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
তারা বলছেন, পল্লী সড়কের গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় পর্যায়ে) প্রকল্পের আওতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মইন উদ্দিন আহমদ মুন্টু নাম দিয়ে ২০২৩ সালের ১৪ অক্টোবর সেতুটির উদ্বোধন করেন সাবেক সংসদ সদস্য ডা. সামিল উদ্দিন আহমেদ শিমুল।
এদিকে কয়েকটি সূত্র বলছে, নির্মাণাধীন সেতুর পাশেই একটি বেইলি সেতু রয়েছে। সেটি নির্মাণের সময় ৯ জনের দুই একর ৩৯ শতক জমি ১৯৯১-৯২ সালে অধিগ্রহণ করা হয়। কিন্তু দুই জনকে অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলেও বাকি সাত জন কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি। তবে সবাই অধিগ্রহণ করা জমিতে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন।
এদিকে নির্মাণধীন সেতুর পাশের বেইলি ব্রিজটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কর্তৃপক্ষ ব্রিজের প্রবেশমুখে ইটের পিলার বানিয়ে তিন বছর ধরে ভারী যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে।এতে করে দুর্লভপুর ও মনাকষার ব্যবসায়ীরা পণ্য আনার জন্য ২০ কিলোমিটার ঘুরে কানসাট ব্রিজ ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে করে বাড়ছে পরিবহন খরচ। সেই সঙ্গে সেতুটি জরাজীর্ণ, সরু ও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সারাদিন যানজট লেগেই থাকছে।সেতুর স্টিলের পাটাতন কয়েক দফা ভেঙে পড়ে যাওয়ার পর মেরামত করে সেতুটি সচল রাখা হয়েছে।
দুর্লভপুরের মুদি দোকান মালিক শাহিন আলী জানান, শিবগঞ্জ বাজার থেকে তার দোকানের দুরত্ব মাত্র চার কিলোমিটার হলেও ট্রাকে করে পণ্য আনার জন্য ৩০ কিলোমিটার ঘুরতে হয়। এতে তার পরিবহন খরচ বাড়ছে।
মনাকষার বাকরুলী বিশ্বনাথপুর গ্রামের হারুন অর রশিদ জানান, তিনি জরুরি কাজে জেলা শহরের যাওয়ার জন্য পাগলা নদীর বেইলি ব্রিজে জ্যামের কারণে আধা ঘণ্টা আটকে থাকার পর তিন কিলোমিটার পায়ে হেঁটেই শিবগঞ্জ শহর চলে আসেন। ততোক্ষণে যার সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা ছিল তিনি চলে গেছেন।
তিনি বলেন, এই দুর্ভোগ শুধু তার একার নয়, তিন ইউনিয়নবাসীর নিত্যদিনের।
মনাকষার জিয়াউল হক জানান, সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় প্রায় দিনই সেতুর এক প্রান্তে প্রায় আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। শিবগঞ্জ উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ এবং বড় দুর্লভপুর, মনাকষা ও বিনোদপুর এ তিন ইউনিয়নের এক লাখ ১৫ হাজার ভোটারসহ সোয়া দুই লাখ জনগোষ্ঠীর ব্যস্ততম এ সেতুটি নির্মাণে ধীরগতির কারণে জনগণের ভোগান্তি চরমে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের পাঁচ মার্চ জেলা এলজিইডি অফিসের ০১-২০২০৯১-২০৯২ স্মারকে সাতজনের নামে অধিগ্রহণ করা জমি থেকে সাত দিনের মধ্যে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে তারা সরে যাননি। উল্টো জেলা প্রশাসকের কাছে সহযোগিতা চেয়ে আবেদন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সেতুর দুই পাশে ৩৪টি বাড়ি উচ্ছেদের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে দুই বার আবেদন করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত উচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
জানতে চাইলে সেতু নির্মাণের ঠিকাদার আব্দুল মান্নান সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সেতুর দুই দিকে প্রয়োজনীয় জমি অধিগ্রহণ ও উচ্ছেদ না হলে কাজ শেষ হবে না। সেতুর কাজ পুরোদমে চলছে। শিগগিরই শেষ হবে। উচ্ছেদের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এখন পর্যন্ত সেতুর ৫৫ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে।
এ বিষয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী হারুন অর রশিদ বলেন, সেতু নির্মাণের জন্য অধিগ্রহণ করা জমি থেকে বাড়িঘর উচ্ছেদের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার হোসেন বলেন, সেতুর দুই দিকের জমি অধিগ্রহণ ও বাড়ি উচ্ছেদের ব্যাপারটি প্রক্রিয়াধীন। আশা করি, শিগগিরই উচ্ছেদ হবে এবং যথাসময়ে সেতুর কাজ শেষ হবে।