সময়ের হিসেবে বছর ঘুরে আসে নতুন বছর। কিন্তু কিছু কিছু বছর আসে বাঁক বদলের বার্তা নিয়ে। রচিত হয় নতুন ইতিহাস। ১৯৬৯ আর ১৯৯০ সালের পর জাতির জীবনে ২০২৪ তেমনি এক বছর। ব্রিটিশ সাময়িকী ইকনোমিস্টের বিচারে, বিদায়ী বছরে বিশ্বজুড়ে নানা ঘটনার এক নাম্বারে ঠাঁই পেয়েছে বাংলাদেশের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান। কেমন ছিলো সেই অভ্যুত্থানের দিনগুলো?
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিলো একটি ব্যারিকেড ভাঙা দিয়ে। ১১ জুলাইয়ে বাঁধ ভাঙা বিক্ষোভ ছিলো জাতির ঘাড়ে চেপে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রথম ধাপ। সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার নামে বৈষম্য বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন ক্রমে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফায়। জনবিচ্ছিন্ন সরকার তা দমনের জন্য আশ্রয় নেয় উগ্র বল প্রয়োগ আর হত্যাযজ্ঞের।
তিন আগস্ট সরকার পতনের এক দফা ঘোষণার পর, বাংলা ব্লকেড আর শহীদি মার্চের মতো চমকে ভেঙ্গে যায় এক দাম্ভিক ক্ষমতার দুর্গ। বিরল গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারের সাক্ষী হয় রাজধানী ঢাকা। পাঁচ আগস্ট সেই জোয়ারে ভেসে যায় একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রতীক গণভবন।
যে কোন স্বৈরাচারের মতোই দেশ ছেড়ে পালাতে বাধা হন শেখ হাসিনা। জুলাই আগস্টের অভ্যুত্থানে শহীদ সহস্রাধিক ছাত্রজনতা। কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক- পতিত সরকারের সব পর্যায়ের মন্ত্রী এমপি ও নেতাকর্মী হয় গা ঢাকা দিয়েছে নয় তো গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের প্রহর গুনছে।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের বিচারে বাংলাদেশের এই গণঅভ্যুত্থান বিশ্বের অন্যতম এক অনন্য ঘটনা। সাময়িকীটির দৃষ্টিতে বর্ষসেরা দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'আমাদের এবারের বিজয়ী বাংলাদেশ, যারা এক স্বৈরশাসককে উৎখাত করেছে।
আরও বলা হয়, আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়, যিনি সাড়ে ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশটি ১৫ বছর ধরে শাসন করছিলেন। দেশের স্বাধীনতার হিরোর এক কন্যা হিসেবে তিনি এক সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি দমন শুরু করেন, নির্বাচনে কারচুপি করেন, বিরোধীদের কারাগারে পাঠান এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। তার শাসনামলে বিশাল অংকের অর্থ আত্মসাৎ করা হয়।
গণঅভ্যুত্থানের পর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেপথ্যে থাকা নেতাদের মধ্যে কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারে গেছেন। বাকিরা গঠন করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটি। তাদের মুখপাত্র সামান্তা শারমিন বলছেন, সরকার পতনের পরিকল্পনা জুলাইয়ের আন্দোলনে ছিলো না। ফ্যাসিবাদী সরকারের দমন নিপীড়নই আন্দোলনকে এমন পরিণতির দিকে নিয়ে গেছে।
অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বলেছেন, বিনা ভোটের নির্বাচন, সীমাহীন দুর্নীতি, অর্থ পাচারের পাশাপাশি বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস পরিস্থিতি ১৫ বছর ধরে মানুষের মনে যে ক্ষোভ তৈরি করেছিলো, সেটাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হাওয়া জুগিয়েছে। একই সঙ্গে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানকে ভবিষ্যতের যে কোন সরকারের জন্যই একটি সতর্ক বার্তা বলে মনে করছেন এই বিশ্লেষক।