২০১৩ সালের ১ জুলাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করার পর থেকে পেয়েছি সহকর্মীদের সহযোগিতা ও ছাত্রছাত্রীদের ভালোবাসা। দিতে পারিনি তেমন কিছুই। যোগদানের পর থেকেই প্রতিনিয়ত ছাত্রদের মুখে লাইব্রেরিতে বই নাই বই নাই কথাটি শুনতে হয়। (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একসময় জগন্নাথ কলেজের লাইব্রেরিতে বইয়ের সংগ্রহ ছিল বিশাল যার অধিকাংশ ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে দেওয়া হয়) কিছুই করার থাকেনা, সত্যিইতো তাদের তো আমাদের মতো প্রচুর বই পড়ার সুযোগ নেই। আমরা যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত প্রচুর বই পড়ার ও দেখার সুযোগ পেয়েছি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ সেলের বই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণায় সহায়ক হয়েছে।
ব্রাহ্ম আন্দোলনের নেতা দীননাথ সেন, অনাথ বন্ধু মৌলিক, পার্বতী চরণ রায়, ব্রজসুন্দর মিত্র প্রমুখের প্রচেষ্টায় ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের যাত্রা শুরু। স্কুলটি আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হলে একে টিকিয়ে রাখার জন্য ১৮৭২ সালে ব্রাহ্ম স্কুলের ভার তুলে দেওয়া হয় বালিয়াটির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে। তিনি ব্রাহ্ম স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ১৮৭২ সালে পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামানুসারে নামকরণ করেন জগন্নাথ স্কুল। প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন পোগজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক গোপীমোহন বসাক। জগন্নাথ স্কুলের যখন রমরমা অবস্থা তখন অনাথ বন্ধু মৌলিক কিশোরীলালকে একটি কলেজ চালু করতে পরামর্শ দেন। ঢাকার উকিল ত্রৈলোক্যনাথ বসু, অনাথ বন্ধু ও বিচারপতি সারদা চন্দ্র মিত্রের চেষ্টায় কিশোরী লাল আইন বিষয় পড়ানোর অনুমিতসহ কলেজ চালুর অনুমতি পান ১৮৮৪ সালে। মাত্র ৪৮ জন ছাত্র নিয়ে জগন্নাথ কলেজ যাত্রা শুরু করে। ১৯০৮ সালের ৭ মার্চ জগন্নাথ কলেজটির ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন ঘটে এবং ট্রাস্টি বোর্ডের পরিচালনায় একটি প্রথম শ্রেণির কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে।
১৯৯৫ সালের ১২ নভেম্বর বেগম খালেদা জিয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে সরকারী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসেবে এর যাত্রা শুরু। ২০০৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ৮ম জাতীয় সংসদের ১৮তম অধিবেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিল ২০০৫ সংসদে উত্থাপিত হয় এবং ২০ অক্টোবর একটি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে কলেজকে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে সত্যিকার অর্থে ২০০৮ সাল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়টি সত্যিকার অর্থেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করেছে। যাত্রা শুরু করে মাত্র ১৩ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরো এগিয়ে যাবে।
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর গ্রন্থের লেখক আবুল মনসুর আহমেদ ছিলেন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। তিনি ১৯১৭ সালে জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজের আয়তন সম্পর্কে তিনি বলেন, জগন্নাথ কলেজ ঢাকা কলেজের চেয়ে তিনগুণ বড় এবং বর্তমান লাইব্রেরির অবস্থা করুণ হলেও একসময় এটি ছিল বিশাল। জগন্নাথ কলেজ এবং কলেজ লাইব্রেরি সম্পর্কে আবুল মনসুর আহমেদ তাঁর স্মৃতিচারণে বলেন, ‘স্কুল-কলেজে এত বড় লাইব্রেরি থাকিতে পারে, জগন্নাথ কলেজেই প্রথম এই জ্ঞান লাভ করি। লাইব্রেরির বিশালতায় বই এর সংখ্যায় ও নাম-না-শোনা ও চোখে-না-দেখা বহু বড় আকারের বই দেখিয়া আমি লাইব্রেরিটার প্রতি আসক্ত হইয়া পড়ি। ক্লাসে পড়া না থাকিলে অথবা অন্যভাবে অবসর পাইলেই আমি লাইব্রেরিতে ঢুকিতাম। অল্পক্ষণেই লাইব্রেরিতে ডুবিয়া পড়িতাম। সবচেয়ে বেশি ডুবিতাম ইতিহাসের বই-এ। কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রিন্সিপাল ললিত চ্যাটার্জী মহাশয় ছাড়াও আরও নামকরা অনেক অধ্যাপক ছিলেন। দর্শনের অধ্যাপক উমেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য, ইতিহাসের অধ্যাপক মিঃ পি. গুপ্ত, ইংরেজির অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র সরকার, অধ্যাপক ফণীন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ অনেকের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইতিহাসের অধ্যাপক মিঃ পি গুপ্ত অধ্যাপনায় তো ভাল ছিলেনই, চেহারা-ছবি ও পোশাকেও তিনি ছিলেন একেবারে ইংরাজ। বিশেষত: তিনি ছিলেন বিখ্যাত অধ্যাপিকা তটিনী গুপ্তার স্বামী। তৎকালে সারা ভারতে এবং ভারতের বাইরেও মিসেস তটিনী গুপ্তা ছিলেন জ্ঞানে-প্রতিভায় বিস্ময় ও শ্রদ্ধার পাত্রী। অধ্যাপকদের মধ্যে শ্রীযুক্ত সতীশ চন্দ্র সরকার ছিলেন শুধু জগন্নাথ কলেজের নয় সকল কলেজের ছাত্রদের এবং ঢাকাবাসী সকলের ভক্তি-শ্রদ্ধার পাত্র। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিয়া ইনি ন্যাশনাল কলেজ ও ন্যাশনাল মেডিক্যাল স্কুল স্থাপন করেন। কলেজটি চলে নাই। কিন্তু মেডিক্যাল স্কুলটি আজও আছে।
জগন্নাথ কলেজের এই অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়ায় ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। মূলত তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের ডিগ্রি ক্লাসের সমস্ত ছাত্র নিয়ে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ কলেজের ডিগ্রি ও অনার্স ক্লাসের ৩১৩ জন শিক্ষার্থী হয়ে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শুধুমাত্র ছাত্র পরিবর্তিত হয়েছে তা নয়। জগন্নাথ কলেজ লাইব্রেরির অধিকাংশ মূল্যবান ও দু®প্রাপ্য বই দিয়ে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। শিক্ষকদেরও একটি বড় অংশ যোগ দেন নতুন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ইন্টারমিডিয়েট কলেজে অবনমিত করা হয়। অধ্যক্ষ ললিত মোহন চ্যাটার্জী এর তীব্র বিরোধীতা করেছিলেন। জগন্নাথ কলেজ এরপর থেকে জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নামে পরিচিত হতে থাকে। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের এই স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২টি হলের নামকরণ করা হলো ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল) ও জগন্নাথ হল।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল আন্দোলন নিয়ে আমাদের প্রতিনিয়ত অনেক কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু ২০০৮ সালে। বিভিন্ন অবকাঠামোগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও জগন্নাথের মতো এত অল্প সময়ে অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় এতটা অগ্রসর হতে পারেনি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত ঐতিহ্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্রদের প্রতিনিয়ত বিভিন্ন প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আবাসিক সুযোগ সুবিধা না থাকা সত্ত্বেও তারা কোন অভিযোগ না করে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে।
প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান স্যার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এগিয়ে আছে তার প্রমাণ ছাত্ররা বিসিএস এ দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে এবং বিভিন্ন চাকুরির পরীক্ষায় ভালো করছে।’ অনেক পণ্ডিত এ বিষয় নিয়ে অনেক সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত বলতে গবেষণায় তার অবদানকে বোঝায় বিসিএস এ সাফল্য নয়। যদিও দিন শেষে চাকুরি প্রাপ্তিকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা দেশে বিদেশে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন। তাদের গবেষণা প্রবন্ধ দেশে বিদেশে নামকরা জার্নালে প্রকাশিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে অনেকের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ আছে যা জগন্নাথের পূর্বে প্রতিষ্ঠিত নামি দামি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে প্রাথমিকভাবে সম্ভব হয়নি।
বঙ্গবন্ধু কন্যার কৃপাদৃষ্টির কারণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছে শুনে আমাদের অনেক শুভাকাঙ্খী কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করছেন। তারা মনে মনে খুশি যে, বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরিত হচ্ছে। অনেক ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখে। অনেকের ধারণা বিশ্ববিদ্যালয় কেরানীগঞ্জে স্থানান্তরিত হলে ছাত্ররা আর তেমন ভর্তি হবে না। বিশ্ববিদ্যালয় স্থানান্তরিত হতে এখনও অনেক দেরি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কোয়ানটিটির চেয়ে কোয়ালিটির প্রতি বেশি মনোযোগী। ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জিপিএ ৮.৫ চেয়েছে যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি। জিপিএ কম চাইলে বেশি ছাত্র ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতো। তাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষকরা আর্থিকভাবে কিছুটা লাভবান হতেন। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা টাকার চেয়ে ছাত্রদের মেধা বিকাশে বেশি মনোযোগী।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ তরুণ শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় তাদের অধিকাংশই বিভাগের প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছেন। তাই মেধা ও মননে জগন্নাথের শিক্ষকরা কোন অংশে কম নয় যার প্রমাণ গবেষণা ও বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় জগন্নাথের ছাত্রদের সাফল্য।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ আমাদের প্রিয় ছাত্র ছাত্রীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পাশাপাশি সরকারি চাকুরীতেও ঈর্ষনীয়! সাফল্য অর্জন করছে।
মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হকের নেতৃত্ব জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রসহ অদূর ভবিষ্যতে সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিবে সেই প্রত্যাশা থাকলো।
"আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব
ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ, জীবন নব নব।"
লেখক পরিচিতি:
তপন পালিত
সহকারী অধ্যাপক ইতিহাস বিভাগ,
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
একাত্তর/এআর