কেউ তাকে চিনতেন ‘মিস্টার টেন পারসেন্ট’ নামে। আবার কারও কাছে পরিচিত ছিলেন নগদে ঘুষ গ্রহণকারী হিসেবে। অবসরের পর এখন থাকেন রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে সাড়ে ১২ হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। যেটির দাম ২৫ কোটি টাকা। বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদের কথা। স্ত্রীর নামেও তিনি গড়েছেন অনেক সম্পদ। বিদেশেও অর্থপাচারের অভিযোগ আছে এই দম্পতির বিরুদ্ধে। যার তদন্তে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর গোয়েন্দা ইউনিট।
শ্বেতপত্র কমিটির বিচারে যদি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হয় শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের একটি, তাহলে এই বিদ্যুৎ ভবন তার আঁতুড়ঘর। এই ভবনে বসে আইনের মারপ্যাঁচ করে আওয়ামী লীগ আমলে নয়-ছয় হয়েছে অন্তত ৭২ হাজার কোটি টাকা। এতো টাকা যেমন তখনকার সরকারের রাজনীতি সংশ্লিষ্ট পুঁজিপতিদের পকেটে যেমন গেছে, তেমনি এই বিদ্যুৎ ভবনের কর্তাদের পকেটেও গেছে।
তেমনি এক প্রতাপশালী এবং প্রভাবশালী কর্মকর্তারা সম্পদের কিছু তথ্য তুলে এনেছে একাত্তর টেলিভিশন।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড পিডিবির সাবেক চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ। সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে তিনি পিডিবির চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসেন ২০১৬ সালের আগস্টে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তার চাকরির বয়স শেষ হলেও দুবছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয় সরকার। তার সময়েই হয় ভারতের আদানির সঙ্গে বিতর্কিত বিদ্যুৎ চুক্তি। দেশের ভেতরেও ডজনের বেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে পিডিবি।
গ্রীষ্মের এক পড়ন্ত বিকেলে রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান দুই এর ৫০ নম্বর সড়কে একটি বাড়ির খোঁজে নামে একাত্তরের একটি দল। বিলাসবহুল আবাসন নির্মাতা শান্তা গ্রুপের তৈরি সেই ভবনের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে বাস করেন খালেদ মাহমুদ। আয়কর নথির সঙ্গে বারবার মিলিয়ে ভবনটিতে যাওয়া হয় দু’দিন।
সাংবাদিক আসার খবরে সব জানালা বন্ধ করা হয় ভেতর থেকে। কিন্তু ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। খালেদ মাহমুদের বাসায় থাকার কথাও অস্বীকার করেন নিরাপত্তারক্ষীরা।
২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর সময়ে ১২ হাজার ৬শ ৭৮ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাট আয়কর নথিতে দেখান খালেদ মাহমুদ। দাম ২৪ কোটি ২০ লাখ টাকার বেশি। ২১ কোটিই শোধ করেন নগদে। যদিও এর বাজারমূল্য আরো বেশি বলছেন গোয়েন্দারা।
এটি কিনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ নেনও খালেদ। কর দেন মাত্র ৯৬ লাখ টাকা। তবে টাকার উৎস আয়কর নথিতে নেই। এভাবে সম্পদ অর্জনে দুর্নীতি হয়েছে মনে করেন টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য ড. ইফতেখারুজ্জামান।
পূর্বাচলেও সরকারের কাছে জমি নিয়েছেন খালেদ মাহমুদ। ২৫ নম্বর সেক্টরে তার প্লটটি সাত কাঠার বেশি। জন্মস্থান ময়মনসিংহেও তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে তার যার দাম দেখানো হয়েছে প্রায় ৫২ লাখ টাকা। ব্যাংকে এফডিআর আছে সোয়া দুই কোটি টাকার। আছে কোটি কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনও।
এবার দেখা চোখ দেই খালেদপত্নী সায়মা জোহরার কিছু সম্পদে। কূটনৈতিক এলাকা বারিধারায় শেলটেকের এই ভবনে একটি ফ্ল্যাট আছে তার। সোয়া তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের দাম দেখানো হয়েছে মাত্র কোটি টাকার কিছু বেশি। অথচ বাজারমূল্য ছয় কোটির বেশি। এটি বিদেশিদের কাছে ভাড়া দেয়া।
ধানমন্ডির ১৪’র এ সড়কের এই ভবনে দুই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট আছে সায়মার। প্রায় তিন কোটি টাকা বাজার মূল্যের ফ্ল্যাটটির দাম দেখানো মাত্র ৭৫ লাখ টাকা। এটিও ভাড়া দেয়া। খালেদ পত্নীর এফডিআর আছে প্রায় আড়াই কোটি টাকার। সব মিলিয়ে মোট সম্পদ পাঁচ কোটি টাকার বেশি।
সবার মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে যিনি শুধু বাসস্থানে পঁচিশ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন,তার মোট সম্পদ কতো হতে পারে? গোয়েন্দা তথ্য বলছে, খালেদ মাহমুদের পরিবারের অনেক সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও সিঙ্গাপুরে থাকেন। এই দুই দেশে অর্থপাচারের তথ্যও খুঁজছেন গোয়েন্দারা। এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করেও খালেদের কাছ থেকে সাড়া মেলেনি। বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষ্ঠু তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
খালেদ মাহমুদের অবৈধ সম্পদের তথ্য সরকারের বিভিন্ন সংস্থার হাতে আছে। তারপরও তথ্যবিহীন উৎস থেকে পাওয়া টাকায় কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে দিব্যি আছেন তিনি। নিয়মিত বসছেন একটি বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদেও। তবে কর গোয়েন্দারা বলছেন, তদন্ত শেষেই ব্যবস্থা নেবেন তারা।