প্রবাদ আছে ‘কাজীর গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নাই’ -ঠিক একই অবস্থা লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট, আলেকজান্ডার, রামগতি ঘাটে। প্রতিদিন এই নৌপথে শত শত যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারি দিচ্ছেন উত্তাল মেঘনা। নৌরুটে চলা ৩০টির বেশি শ্যালো ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, স্পিডবোটে নেই লাইফ জ্যাকেট। এমনকি নেই প্রাথমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। অথচ ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে এই রুটে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার চলাচল পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। তাদের ভাষ্য, এসময় সি-ট্রাক দিয়ে চলাচলের নির্দেশনা আছে। নেওয়া হয়েছে সচেতনতামূলক কার্যক্রমও। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম কেবল কাগজেই থাকে। মাঠে এর কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায় না। নিষেধাজ্ঞা আছে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো।
সরেজমিন, লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট ঘাট থেকে ভোলা, হাতিয়া, চেয়ারম্যানঘাটসহ বিভিন্ন রুটে প্রতিদিনই ছোট ছোট ট্রলারে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। ঘাটে নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, নেই নৌ-পুলিশ বা কোস্টগার্ডের তৎপরতা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, কাগজে-কলমে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বাস্তবে কিছুই নেই। কিছু অসাধু নৌ-পুলিশ ও কোস্টগার্ড সদস্যকে ম্যানেজ করেই চলছে এই পরিবহন।
ভোলা থেকে লক্ষ্মীপুরগামী যাত্রী আমজাদ হোসেন বলেন, মাঠে কাজ করি। প্রতিদিন যাওয়া-আসা লাগে। বিকল্প কিছু নাই। ভয় হয়, কিন্তু উপায় কী?
আরেক যাত্রী রুকসানা বেগম বলেন, শিশু নিয়ে চলাচল করি। ট্রলারে কোনো নিরাপত্তা নাই। মাঝ নদীতে ঢেউ উঠলে আল্লাহর ওপর ভরসা করা ছাড়া কিছুই করার থাকে না।
এদিকে নৌ চালকরাও বলছেন, বাধ্য হয়েই চালাতে হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রলার চাল বলেন, নিষেধাজ্ঞার কথা সবাই জানে। কিন্তু যাত্রীর চাপ আছে, আবার লোকজন ম্যানেজ করেই চালাই। দিন আনে দিন খাই, চলাচল বন্ধ করলে পরিবার না খেয়ে মরবে।
সংশ্লিষ্ট তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে এ নৌরুটে প্রাণ গেছে অন্তত ২০ জনের। নিখোঁজ রয়েছেন আরও সাত জন। এবার ঈদেও হাতিয়ার চর মেঘনায় ট্রলার ডুবে মারা যান লক্ষ্মীপুরের সাইফুল ইসলামসহ তিন জন। এখনও নিখোঁজ তিন বছরের এক শিশু।
স্থানীয় জেলে শহিদুল বলেন, চোখের সামনেই ট্রলার উল্টে মানুষ মারা গেছে। তারপরও কিছুই পরিবর্তন হয় নাই।
বিআইডব্লিউটিএ মজুচৌধুরীর হাট নদী বন্দরের সহকারী পরিচালক শাহ আলম বলেন, আমরা ১৫ মার্চ থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইঞ্জিনচালিত ট্রলার চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করি। এসময় সি-ট্রাক দিয়ে চলাচলের নির্দেশনা আছে। সচেতনতামূলক কার্যক্রমও নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম কেবল কাগজেই থাকে। মাঠে এর কোনো বাস্তবায়ন দেখা যায় না। অবতরণ ঘাটগুলোর অবস্থাও করুণ। নেই কোনো স্থায়ী অবতরণ ঘাট। যাত্রীরা বাঁশের সাঁকো ও ভাঙা কাঠের সেতু পেরিয়ে ট্রলারে ওঠেন। বর্ষায় পানি বাড়লে এই পথ আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
এর স্থায়ী সমাধান দাবি করে তারা বলেন, অবিলম্বে বিকল্প সেতু, নিরাপদ সি-ট্রাক সার্ভিস চালু ও ট্রলার চলাচলে কার্যকর নজরদারি না হলে যে কোনো সময় বড় ধরনের ট্র্যাজেডি ঘটবে।
চর রমণী মোহন ইউপি সদস্য নয়ন আক্তার বলেন, প্রতিটি বর্ষায় এই নদীপথে মানুষ মরছে। দায় এড়ানোর সময় এখন নয়, ব্যবস্থা না নিলে আরও প্রাণ যাবে।