জাপানি খাবার বলতে বাঙালি সমাজে অনেকেই চেনে ‘সুশি’, ‘রামেন’, ‘টেম্পুরা প্রন’, ‘তোফু’ ইত্যাদি। আর ঝাঁঝের জন্যে মনে করিয়ে দেয় ‘ওয়াসাবি’র কথা।
কিন্তু উদিত সূর্যের দেশ জাপানের খাদ্য সম্ভার কি আদপেই এতো সীমিত? চলুন জেনে নেয়া যাক দ্বীপরাষ্ট্রটির অসম্ভব জনপ্রিয় এক ‘সুপার ফুড’ সম্পর্কে। নাম যার নাত্তো। যে খাবারের উদ্ভব ও বিস্তারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে সামুরাইদের বীরত্বের গল্প। জাপানে জেন বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার এবং খাদ্য ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জাপানি কিছু সংস্কার।
চলুক তাহলে একটা গল্প জেনে নেই।
জাপানে তখন সামুরাই আমল। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের দক্ষতা এবং দুর্দম সাহসের কারণে সামুরাইয়ের আদর্শ প্রতীকে পরিণত হয়েছিলেন মিনামতো নো ইয়োশি। রণক্ষেত্রে অসামান্য পারঙ্গমতার জন্য তাকে ডাকা হতো ‘হাচিমান তারো’ বলে। যার অর্থ যুদ্ধদেবতার সন্তান। মিনামোতো শোগুন ছিলেন না। সম্রাট সেইওয়ার আমলে যুবরাজ সাদাজুমির অধীনে তিনি ছিলেন জাপানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেনাপতি। পরে মুৎসু প্রদেশের গভর্নর হন তিনি।
গভর্নর থাকার সময়ে তিন বছর মেয়াদি এক গৃহযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন কিওহারা গোত্রের বিরুদ্ধে। ১০৮৬ থেকে ১০৮৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনো এক সময়ে তিনি ছিলেন এক সামরিক অভিযানে ব্যস্ত। সঙ্গের সৈন্যদের নিয়ে রাত্রিযাপনের জন্যে আশ্রয় নিলেন একটি গ্রামে। শুরু হলো রাতের খাওয়া-দাওয়ার তোড়জোড়। সেদ্ধ করা হলো ভাত আর সয়াবিন। এরই মধ্যে স্কাউটরা নিয়ে এলো যে শত্রুপক্ষ এগিয়ে আসছে। জাপানি লোকগাথার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বীর হিসেবে অভিহিত হাচিমান তারো যুদ্ধ করতেন সবসময় অগ্রপশ্চাত বিবেচনা করে। তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আপাতত পিছু হটবেন। কারণ সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত না। কৌশলগত এই পশ্চাদপসরণের সময় মিনামোতোর সেনারা নিজেদের খাবারও সঙ্গে নিয়ে নিলেন। সদ্য রান্না সেদ্ধ সয়াবিন আর ভাত খড়ে মুড়ে ঘোড়ার পিঠে চাপিয়ে পিছু হঠা শুরু করলেন। টানা তিন দিন ধরে চললো এই যাত্রা। বসে খাওয়ার জন্য ফুরসতও মিললো না।
শেষমেশ এক জায়গায় দু’দণ্ড স্থির হয়ে যখন সৈন্যদের সেই সয়াবিনের দিকে নজর গেলো তারই মধ্যে সেদ্ধ সয়াবিনতো গেছে গেঁজে। অর্থাৎ ফারমেনটেড হয়ে গেছে। তবুও কেউ কেউ একটু চেখে দেখলো। আর আমাদের গল্প কথক বলছেন, ফারমেন্টেড সেই সয়াবিন সৈন্যদের ভালোও লাগলো। সেনাপতি মিনামোতোকেও দেয়া হলো সেই গাঁজানো সয়াবিন। নতুন স্বাদের সেদ্ধ সয়াবিন তার ভালো লাগলো। এরপর থেকেই জাপানে দিনে দিনে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠলো নাত্তো- অর্থাৎ ফারমেন্টেড সেদ্ধ সয়াবিন।
প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, মিনামতো ও তার সৈন্যদল যেখানে নাত্তোর উদ্ভাবন করেন সেই জায়গা হচ্ছে, ইবারাকি অঞ্চলের মিতো শহর। হুট করে উদ্ভাবিত এই খাবার এখন কোটি কোটি মানুষ খাচ্ছে। খাচ্ছেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা জাপানিরা।
নাত্তো নিয়ে আরও একটি গল্প রয়েছে। সেই গল্প আরও আরও পুরনো। খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর সময়কার। যুবরাজ সোতোকুকে নিয়ে। ইনি ছিলেন জাপান সম্রাট ইয়োমেই-এর সন্তান। কর্মজীবনে তিনি রাজার অভিভাবকও ছিলেন। জাপানের বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারে তার রয়েছে বিপুল অবদান। গল্প কথক বলছেন, তিনি নাকি একদিন নিজের ঘোড়াকে খাওয়ানোর জন্যে সয়াবিন সেদ্ধ করেছিলেন। কোনো এক কারণে সেই সেদ্ধ সয়াবিন খড়ে মুড়িয়ে রাখার প্রয়োজন পড়ে।
অনেকে আবার বলেন যে খড়ে মোড়া সেদ্ধ সয়াবিন নাকি সোতোকু উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন এক অমার্ত্যের কাছ থেকে। সেই খড়ে মোড়ানো সেদ্ধ সয়াবিন ক’দিন পর চেখে দেখলেন যে বেশ লাগে খেতে। যুবরাজের দেখাদেখি দরবারের অর্মাত্যরাও খেলেন। তারপরে খেতে শুরু করলো সাধারণ জন-মানুষ। জনপ্রিয় হয়ে উঠলো নাত্তো নামের খাবারটি।
অনেকে বলেন, জাপানে যখন বৌদ্ধধর্মের উত্থান চলছে সেই সময় নিরামিষ খাবার হিসেবে জেন বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে নাত্তো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বৌদ্ধ এই সন্ন্যাসীদের খাদ্যপ্রণালীকে বলা হয়, ‘শোজিন-রাইওরি’। অর্থাৎ যে খাদ্য প্রক্রিয়ায় কোনোরকমের প্রাণি মাংস নেই। সবজি ও পাহাড়ি লতা নির্ভর খাবারদাবার। এমনকি পেঁয়াজ-রসুনও রান্নায় ব্যবহার করা হয় না। সেদিক থেকে নাত্তো দশে দশ। কিছু ইতিহাসবিদ এমনকী ইয়ায়োই যুগে (৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ - ৩০০ খ্রিস্টাব্দ) চীনা ঝো রাজবংশের জাপানে আগমনের সময় এরকম গাঁজানো সয়াবিন থেকে নাত্তোর উৎপত্তি হতে পারে বলে মনে করেন।
এইসব লোক গল্পের প্রত্যেকটিই, ‘নাত্তো’ নামের খাবারটিকে জাপানের ইতিহাসের জনপ্রিয় বীরদের সাথে সম্পৃক্ত করে। এই সম্পৃক্তকরণ প্রমাণ করে যে নাত্তো, জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার।
তবে এটা নিশ্চিত যে, নাত্তো বহুদিন ধরে ‘ওয়াশোকু’ এর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ওয়াশোকু শব্দটির অর্থ হচ্ছে, ‘জাপানি খাবার’। ফিউশন নয়। জাপানের একান্ত নিজস্ব যে খাবার তাই ওয়াশোকু। আর জাপানি এবং পাশ্চাত্যের ফিউশনে যে খাবার মানুষের পাতে উঠেছে তাকে বলে ‘ইয়োশোকু’। এই যে টেম্পুরা-এটা কিন্তু ফিউশন খাবার। পর্তুগীজদের কাছ থেকে এর ব্যবহার জাপানিরা শিখেছিলেন চারশ’ বছর আগে পর্তুগিজ মিশনারিদের থেকে। আর যেখানে জাপানিরা এটা শিখলেন সেই শহরটার নাম নাগাসাকি। ইতিহাসের কি খেলা!
জাপানি খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, নাত্তো পরিবেশন করা হয় টারে সস, কারাসি মাস্টার্ড অথবা সোয়া সস দিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সঙ্গে থাকে ভাত। নানা সিজনিংও থাকে সঙ্গে। সকালের খাবার হিসেবে এক বাটি ভাতের সঙ্গে নাত্তো আধুনিক জাপানিদেরও প্রিয়। শুধু প্রিয় বললে একটু ভুল হয়, অসম্ভব প্রিয়। জাপানের ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রণালয়ের ২০১৬ সালের এক হিসাব বলছে, একজন জাপানি প্রতি বছর গড়ে ৪১ প্যাকেট নাত্তো খেয়ে থাকেন। এমনকি করোনাভাইরাসের মধ্যেও জাপানে নাত্তোর বিক্রি বেড়েছিলো কয়েকগুণ।
নাত্তো গাঁজানো বলে একটা উগ্র স্বাদ আছে এর, কিন্তু তা উগ্রবাদী নয়। তবে হ্যাঁ, সবার নাকের ক্ষমতাতো এক রকম নয়। পুরনো চিজের গন্ধের সাথে নাত্তোর মিল পাওয়া যায় অনেকটা। সাথে একটা মাটি মাটি গন্ধ। খাবারটা আঁঠালো। স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবেও নাত্তোর জনপ্রিয়তা রয়েছে জাপান ও জাপানি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। পটাশিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিন সি ছাড়াও অনেকগুলো পুষ্টিকর উপাদান রয়েছে নাত্তোতে। একারণেই নাত্তোকে বলা হয় জাপানের ‘আদি ও আসল’ সুপার ফুড।