বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার একদিন আগে খুনিরা মানুষের মনে ভয় ও পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীতে দিনে ও রাতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কেন্দ্রীয় সংবাদ সংস্থা বাসসের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
ওই কর্মকাণ্ডগুলোকে হত্যাকাণ্ডের আগের ‘মহড়া’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন প্রফেসর সিদ্দিক।
তিনি বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনের কর্মসূচি ছিল। কর্মসূচির মধ্যে ছিল- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসে ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে ভাষণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পরিদর্শন এবং উপাচার্য ভবনে শিক্ষকদের সঙ্গে মিলিত হওয়া।
অধ্যাপক সিদ্দিক বলেন, আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম।
আমার এখনও মনে পড়ে, কলা ভবনে নিচ তলায় আমাদের বিভাগ ছিল। ১৪ আগস্ট দুপুরে ক্লাস শেষ করে আমরা যে যারা মতো হলে বা বাসায় ফিরছি। আমরা যখন বিভাগের সামনে আসি তখন দেখি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের করিডোর শেখ কামাল এবং তার কয়েকজন সহপাঠী বেরিয়ে আসছেন।
১৫ আগস্ট সমাজবিজ্ঞান বিভাগে সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটি নৃতাত্ত্বিক যাদুঘর পরিদর্শনের কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর। সম্ভবত শেখ কামাল এবং তার সহপাঠীরা সেই যাদুঘরের সাজসজ্জা এবং প্রস্তুতি ঠিকঠাক আছে কি না তা দেখে বেরিয়ে আসছিলেন।
সেদিন ক্যাম্পাসে ব্যস্ত সময় পার করছিলেন আমাদের উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মতীন চৌধুরী। তিনি সারাদিন সাজসজ্জা, ব্যবস্থাপনাগুলো ঠিকঠাক আছে কি না ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন। কয়েকদিন আগে থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজসাজ রব পড়ে গিয়েছিল।
কিন্তু তার মধ্যেই ঘটে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সেদিন (১৪ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক বোমা বিস্ফারণের ঘটনা হয়।
প্রফেসর সিদ্দিক দাবি করেন, সেই বোমা বিস্ফোরণ ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। কেননা বঙ্গবন্ধু পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন, তাই ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করতে তুলতে চেয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। যাতে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে না পারেন। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক বোমার বিস্ফোরণ অবশ্যই দেশের জন্য একটি বড়ো দুর্ঘটনা। এর মধ্য দিয়েও খুনি, ষড়যন্ত্রকারীরা মানুষের মনের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করাতে শুরু করেছিল। এগুলো করার কারণ, পরদিন যেন মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে না পারে।
তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে তদন্ত কমিশন গঠন করা এ জন্যই জরুরি যে, সেদিন কেন এই বোমা বিস্ফারণ করা হলো তা জানা উচিত। যদিও এই ঘটনা কেন ঘটানো হয়েছিল তা আমরা জানি। এগুলোর যথাযথ তদন্ত হলে অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে এবং সেগুলোর অথেনটিকেশনও অনেক মজবুত হবে।
সাবেক এই উপাচার্য বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলো ১৫ আগস্ট সকালে। ১৪ আগস্ট রাতে কিছু সেনা সদস্য (যারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত তারা) সেই সময় নির্মাণাধীন বর্তমানে শাহজালাল বিমান বন্দরে জমায়েত হয়। পরে তারা বিভিন্নভাবে বিভক্ত হয়ে আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাসভবন এই সব জায়গায় তারা গ্রুপ করে গেছে। এখানেই শেষ নয়, রাতের বেলা তারা গোলাবিহীন ট্যাঙ্ক নিয়ে রাস্তায় এসেছে। এমন রণসজ্জায় তারা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় ঘোরা ফেরা করেছে, যাতে মানুষের মনে আগে থেকেই ভয় ভর করে বসে।
এগুলো ছিল ১৪ আগস্টে ঘটনা। যা পরদিন ১৫ আগস্টে একটি অধ্যায়ে শেষ করে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র অনেক আগে থেকেই হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সেই ষড়যন্ত্রকারীরা এই দেশ বহুদিন পরিচালনা করেছে। এগুলো পুরোটাই ছিল সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। সেই ষড়যন্ত্রকারীরা এখনও সক্রিয়।
পরে আমরা লক্ষ্য করলাম ১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর জেল হত্যাকাণ্ড ঘটলো। এর পর আবার ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।
১৪ আগস্টের যে ঘটনা গুলো আমাদের মনের মধ্যে সেই বেদনাগুলোই এনে দেয়- যদি আমরা আরেকটু সতর্ক থাকতাম, তাহলে হয়তো জাতির পিতাকে এভাবে জীবন দিতে হতো না।
শেষে প্রফেসর সিদ্দিক বলেন, ১৫ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে, তার আগের দিন ১৪ আগস্ট খুনিরা সেই মহড়া দিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে বোমা হামলা, সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে মানুষকে আগে থেকেই ভয় দেখানো স্পষ্ট সেই ইঙ্গিতটি করে।
এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ষড়যন্ত্রকারীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠনের রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি জানিয়েছেন, এ বছরের মধ্যেই কমিশনটি চালু হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রফেসর সিদ্দিক বলেন, এটি ভালো খবর। ইতিমধ্যে বহু বিলম্ব হয়ে গেছে। অতি দ্রুত এটি বাস্তবায়ন করা উচিত। এটি কার্যকর হলে বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্ব জানতে পারবে বাংলাদেশের জাতির জনককে কারা, কেন এবং কোন ষড়যন্ত্রে হত্যা করা হয়েছিল।
একাত্তর/এসি