সামরিক বাহিনীর প্রায় দেড় হাজার সদস্যকে গুম ও হত্যার দায়ে জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচারের দাবি করেছেন আশির দশকে গুম হওয়া পরিবারগুলোর স্বজনরা।
সেই সঙ্গে কমিশন গঠন করে প্রকৃত সত্য উদঘাটনের পাশাপাশি জাতীয় সংসদ ভবন চত্বর থেকে জিয়ার কবর সরিয়ে নেয়ার দাবিও জানিয়েছেন তারা।
এছাড়া ১৯৭৭ সালে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান মুক্তিযোদ্ধা সামরিক সদস্যদের গুম ও খুন করেছে মন্তব্য করে তার মরণোত্তর বিচার দাবি করেছেন মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রী।
প্রায় ৭০ বছরের নূরুন্নাহার বেগম। ৪৫ বছর ধরে স্বামী সার্জেন্ট দেলোয়ার হোসেনকপ খুঁজছেন । যিনি বিমান বাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের সময় নিখোঁজ হয়েছেন।
আবার মোশরাফুল ইসলামের মেয়ে মাকসুদা পারভীন। ১৯৭৭ সালে তার বয়স ছিলো চার বছর। বাবার জন্য এখনও তার অপেক্ষা।
এমনই হতভাগ্য পরিবারগুলোর স্বজনরা আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে মঙ্গলবার দুপুরে বিচারের দাবি নিয়ে জড়ো হন শহীদ মিনারে।
‘১৯৭৭ সালে খুনি জিয়ার সামরিক ষড়যন্ত্রের শিকার আমরা’ শীর্ষক ব্যানারে আয়োজিত আলোচনা সভায় অংশ নিয়ে তারা তুলে ধরেন সেই সময়ের বিভীষিকাময় সব ঘটনা।’
তারা বলছেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে পুঁজি করে শত শত সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
‘খুনি জিয়ার গুম ষড়যন্ত্রে’ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বলেন, সেনাশাসক জিয়ার নির্দেশে গঠিত বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে কথিত বিচারে ফাঁসি হওয়া ২০৯ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়।
কিন্তু ওই ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ছিল এক হাজার ১৪৩ জন। কারাদণ্ড ভোগ করেছিলেন সেনা ও বিমান বাহিনীর আড়াই হাজার সদস্য।
সেই ঘটনায় যাদের খুনি জিয়া সামরিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অন্যায়ভাবে ফাঁসি ও কারাদণ্ড দিয়েছে, চাকরিচ্যুত করেছে, তাদের নির্দোষ ঘোষণা করার দাবি জানান ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা।
শুধুমাত্র এ ঘটনাই নয়। জিয়াউর রহমানের পুরো শাসনামল জুড়েই ছিলো গুম আর হত্যা। তাই তাদের কবরগুলো চিহ্নিত করা, নিহতদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, জিয়ার মরণোত্তর বিচার ও সংসদ ভবন চত্বর থেকে জিয়ার কবর সরানোর দাবিও উঠে আসে আলোচনা সভায়।
সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, জিয়াউর রহমানের মতো একজন হৃদয়হীন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
বিগত সময়ে যদি কাউকে তৈমুর লঙ, চেঙ্গিস খান, নাদির শাহ উপাধি দিতে হয়, তাহলে খুনি জিয়াকে দিতে হবে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যা, জাতীয় চার নেতাকে হত্যা এবং ১৯৭৭ সালের হত্যাকাণ্ডের মূল নেতৃত্বে ছিল খুনি জিয়াউর রহমান।
মুক্তিযোদ্ধা সামরিক সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়ার অবস্থান হয়েছে মীর জাফরের পাশে। যুদ্ধেও তিনি পাকিস্তানের চর হিসেবে কাজ করেছেন বলেও উল্লেখ করেন এই বিচারক।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা রয়েছে। তিনি ছিলেন বর্ণচোরা মুক্তিযোদ্ধা।
ওয়ার কাউন্সিল গঠন করে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সংগঠিত মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্র করেছিলেন। যারা ১৯৭৫ এর হত্যাকাণ্ডের পেছনে ছিল তাদেরও শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মন্ত্রী বলেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর প্রহসনের বিচারের নামে ১১০০ জনের বেশি সেনা ও বিমান বাহিনীর সদস্যকে হত্যা করেছে জিয়াউর রহমান।
আরও কয়েক হাজার সদস্যকে গুম করা হয়েছে। তারা প্রায় সকলেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রহসনের বিচারে কৌশলে তাদের খুন ও গুম করেছে জিয়া।
তিনি বলেন, পৃথিবীতে মরণোত্তর বিচারের নজির আছে। বহু দেশে মরণোত্তর বিচার হয়েছে। সাজা না পেলেও ইতিহাসে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে অনেকেই।
খুনি জিয়া ও তার সহযোগীদের মরণোত্তর বিচার দাবি হোক। এটা কোনো বেআইনি হবে না। কী ঘটেছে সেটার সত্য উদঘাটন করাও আইনের দায়িত্ব।
সেই দায়িত্ববোধ থেকে জিয়ার মরণোত্তর বিচার হওয়া বাঞ্ছনীয় ও জরুরি। কমিশন গঠন করে এই হত্যার বিচার করতে হবে।
সভায় জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার এবং সংসদ ভবন এলাকা থেকে জিয়ার কবর অপসারণ, ১৯৭৭ সালে ফাঁসি, কারাদণ্ড ও চাকরিচ্যুত সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের নির্দোষ ঘোষণা করা এবং প্রত্যেককে সর্বোচ্চ র্যাংকে পদোন্নতি দেখিয়ে সব সুযোগ সুবিধা প্রদানসহ সাত দফা দাবিও জানান ‘৭৭ সালে ফাঁসি ও গুমের’ শিকার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার।
আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ বীর বিক্রম, মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক, বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক খন্দকার বজলুল হকসহ ১৯৭৭ সালে গণ-ফাঁসি ও গণ-গুমের শিকার সেনা ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের সন্তানরা।
একাত্তর/আরএ