কোনো স্বজনপ্রীতি নয়, একজন কামারও যেন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারেন, এমন দেশ গড়ার প্রত্যয় জানিয়েছেন নতুন জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেছেন, সংসদে কে যাবে নির্ধারণ করবে জনগণ। দলটির আরেক শীর্ষ নেতা সারজিস আলম বলেছেন, সব দলের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সম্মান থাকলে দেশ হবে অনবদ্য। নতুন দলের মুখ্য সমন্বয়ক পদে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, তারা জনগণের সামনে এসেছেন নতুন বাংলাদেশের আশা আর নতুন বাংলাদেশের জাগরণ নিয়ে।
শুক্রবার ছুটির দিন দুপুরের পর থেকেই স্লোগানে স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকা। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশের নানা প্রান্ত থেকে সংসদ ভবনের ভবনের সামনে নামে মানুষের ঢল। জুলাই অভ্যুত্থান যাদের হাত ধরে, সেই তরুণদের রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতেই মানিক মিয়া অ্যাভেনিউতে জড়ো হন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছাত্র-জনতা।
বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে প্রথমে কোরআন তিলাওয়াত। পরে গীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল থেকে পাঠের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন দলের আত্মপ্রকাশের আনুষ্ঠানিকতা। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর পরিবেশিত হয় জাতীয় সংগীত। দশ মিনিট পর দলটির তুর্কি নেতারা একের পর এক বক্তব্য রাখতে শুরু করেন।
এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, বিভাজনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে একতার রাজনীতি করতে চান তারা। তিনি বলেন, আমরা গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগের দু:শাসনের কবর রচনা করেছি। সংসদ ভবনে কে যাবে সেটা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনগণ, ভারত নয়।
তিনি বলেন, এই সংসদ ভবনে কে যাবে, তা নির্ধারণ করবে বাংলাদেশের জনতা। আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে চাই। যেখানে কোনো ভেদাভেদ থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, স্পষ্ট হত্যাকাণ্ডকে বিডিআর বিদ্রোহ বলে চালানো হয়েছে। আপনারা দেখছেন শাপলা চত্বরে আমাদের দাঁড়ি-টুপিওয়ালা ভাইদের ওপরে রাতের অন্ধকারে কীভাবে গণহত্যা চালানো হয়েছে। আপনারা দেখেছেন কীভাবে দিনের ভোট রাতে দেওয়ার সংস্কৃতি চালু হয়েছে।
হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা স্টেট গড়তে পারিনি। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। আমরা সুশাসন নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা স্বাধীন বিচার বিভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি। আমরা কমিটমেন্ট দিতে চাই, আমাদের ইন্সটিটিউটগুলোকে প্রোপারলি গড়ে তুলব। বিভাজনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আমরা একতার রাজনৈতিক বাংলাদেশে চালু করব। আমরা স্টেট উন্নয়ন করব।
আর নতুন দলের উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, নতুন প্রজন্মকে আগাতে না দিলে বড় দল স্বৈরাচারে পরিণত হবে। তিনি আরও বলেন, এই মঞ্চ থেকে আমরা শপথ নিতে চাই, এই ছোট জীবনে এত বড় দায়িত্বের আমানতকে যেন আমরা খেয়ানত না করি।
বাংলাদেশকে সুসংগঠিত করতে চাইলে সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বলে মন্তব্য করে সারজিস আলম বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে ঐক্যের বাংলাদেশ। হাসিনা দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। সব রাজনৈতিক দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংগঠিত করতে হবে। খুনি হাসিনার বিচার আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে করতে হবে। কোনও অপরাধীর মুক্তির জন্য আমরা যেন থানায় না যাই।
তিনি বলেন, যারা বড় রাজনৈতিক দল রয়েছে, তারা যদি ছোট দলকে এগিয়ে যেতে না দেয় তাহলে আবার একটি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতে পারে। খুনি হাসিনাকে দেখে যেন আমরা সেই শিক্ষা নিতে পারি। আমরা দেশ এবং জাতিকে সবার ওপরে রেখে যেন নতুন ও সাম্যের বাংলাদেশ গঠন করতে পারি।
জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, আমরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে একটি নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি এই চব্বিশে। সেই ঐতিহাসিক বিজয়ের আরেকটি সন্ধিক্ষণে আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি। গত ১৫ বছরে যখনই গণতন্ত্রের কথা বলেছি তখনই গুম-খুন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছাত্র-জনতা আজ এখানে উপস্থিত হয়েছে। আমরা আপনাদেরকে কোনও লোভ দেখিয়ে বা টাকা দিয়ে নিয়ে আসিনি। কিন্তু আমরা আপনাদেরকে একটা জিনিস দিতে পেরেছি সেটি হলো নতুন বাংলাদেশের আশা, নতুন বাংলাদেশের জাগরণ। ৫ আগস্ট যেই সংসদ ভবনকে স্বৈরাচারমুক্ত করা হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক সংসদ ভবন থেকে একটি নতুন রাজনৈতিক দল ঘোষণা করতে যাচ্ছি।
আর স্বাধীনতার ৫৩ বছরে বাংলাদেশকে কেউ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন, জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। তিনি বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদের ত্যাগ আমাদের ওপর এই দায় চাপিয়ে দিয়েছে। এই দায় অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
সামান্তা বলেন, আমরা অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করে যাচ্ছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গত ৫৩ বছর একটা বাইনারি পলিটিক্সের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছিল। আমাদের কোনো অপশন ছিল না, হয় একটি না হয় আরেকটি। যেখানে আমরা আমাদের নাগরিক অধিকারের কথা ভুলতে বসেছিলাম।
এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক বলেন, এখন একটি সময় এসেছে। সেই সময় করে দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া গণঅভ্যুত্থান। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আমরা বাংলাদেশের একটা রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটানোর একটি স্বপ্ন দেখতে পাচ্ছি। এই স্বপ্নের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কথা বলছি। কারণ বাংলাদেশকে কেউ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। আমাদের এই উদ্যোগ নিতে হবে।
আর দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা বলেছেন, আমরা রাজনীতি ক্ষমতা দখলের জন্য করতে আসিনি। জনগণের ক্ষমতা জনগণকে ফিরিয়ে দিতে এসেছি। আমরা এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে যেকেউ তার যোগ্যতা ও সততার ভিত্তিতে জনগণকে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এতে তার পারিবারিক পরিচয় মুখ্য হয়ে উঠবে না।
এ সময় রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধেও কথা বলেন তাসনিম জারা। তিনি বলেন, ক্ষমতা থাকবে জনতার হাতে। এছাড়া স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে পণ্য পরিণত হতে দিতে চায় না তার দল- এমনটাও জানান তিনি।