একাধারে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী, শিক্ষক ও সুরকার হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন সাদি মহম্মদ। তার গানের সুরে বুঁদ হয়ে থাকতেন শ্রোতা-দর্শকরা। তবে হঠাৎ বুধবার অসীমের পানে পাড়ি জমালেন কিংবদন্তি এই সংগীতশিল্পী। নিজ বাসার একটি কক্ষ থেকে ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয় তার।
২০২৩ সালের বছরের জুলাই মাসে সাদি মহম্মদের মা জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ মারা যান। পরিবার জানাচ্ছে এরপর থেকেই নানান মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। মা হারানোর বেদনা কোনোভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না তিনি। এভাবেই চলছিল।
বুধবার এদিন রোজা রাখেন, ইফতারও করেন। এমনকি সন্ধ্যার পর নিজের রুমে গিয়ে তানপুরা নিয়ে সংগীত চর্চাও করেন সাদি সাদি মহম্মদ। এরপরই না ফেরার দেশে পাড়ি জমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে ধারণা করছেন সবাই।
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন সাদি মহম্মদ। তিনি ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ পিতার সন্তান। তার বাবার নাম শহীদ সলিমউল্লাহ। মায়ের নাম জেবুন্নেছা সলিমউল্লাহ। ১৯৭৩ সালে বাবা-মায়ের ইচ্ছায় বুয়েটে ভর্তি হয়েছিলেন সাদি মহম্মদ। তবে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মন বসাতে পারেননি এই সংগীতশিল্পী।
১৯৭৫ সালে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকালে গানের টানে স্কলারশিপ নিয়ে শান্তিনিকেতনে সংগীত নিয়ে পড়তে চলে যান সাদি মহম্মদ। বিশ্বভারতী থেকে রবীন্দ্রসংগীতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। সেই থেকে গানের জগতে পথচলা শুরু সাদি মহম্মদের।
বর্ষা ও বসন্তের গান ভীষণ পছন্দ করতেন সাদি মহম্মদ। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র, উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেনের সিনেমা ছাড়াও হলিউডের ‘দ্য বাইসাইকেল থিফ’, ‘রোমান হলিডে’ ছিল তার পছন্দের চলচ্চিত্রের তালিকায়। এ ছাড়া বই পড়তে ভালোবাসতেন। তার প্রিয় লেখকদের মধ্যে একজন ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
রবীন্দ্রসংগীতে সাদি মহম্মদের মূল পরিচিতি গড়ে উঠলেও আধুনিক গানেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অসংখ্য রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম প্রকাশ হয়েছে তার কণ্ঠে। সঙ্গে আধুনিক গানও। এ ছাড়াও তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠন রবিরাগের পরিচালক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।
২০০৭ সালে ‘আমাকে খুঁজে পাবে ভোরের শিশিরে’ অ্যালবামের মধ্যদিয়ে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন সাদি মহম্মদ। এছাড়া ২০০৯ সালে তার ‘শ্রাবণ আকাশে’ ও ২০১২ সালে তার ‘সার্থক জনম আমার’ অ্যালবাম প্রকাশিত হয়।
১৯৭১ সালে মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের সি-১২/১০ বাড়িটি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা সলিমউল্লাহর বাড়িতে নিয়মিত বৈঠকে আসতেন দলের শীর্ষ নেতারাসহ শেখ কামালও।
একাত্তরের ২৬ মার্চ অবাঙালি বিহারি ও পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে সলিমউল্লাহর বাড়ি। পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের পুরো বাড়ি। পাশাপাশি গুলি করে হত্যা করা হয় সাদি মহম্মদের বাবা সলিমউল্লাহকে। পরবর্তীতে তার বাবার নামেই ঢাকার মোহাম্মদপুরের সলিমউল্লাহ রোডের নামকরণ করা হয়।
২০১২ সালে তাকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করে চ্যানেল আই। ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পেয়েছেন রবীন্দ্র পুরস্কার।