দাম বাড়ানোর পরও জ্বালানিতে সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
তিনি বলেন, কয়েক মাস আগে বিশ্ব বাজারে প্রতি ব্যারেল ডিজেলের মূল্য ছিলো ১৭০ মার্কিন ডলার। সেই সময় জ্বালানি মূল্য সমন্বয় করলে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম হতো ১৬০ টাকা। বর্তমানে সেই মূল্য কমে ১৩৯ মার্কিন ডলার হয়েছে। আমরা এখন সমন্বয় করেছি, যেন ১৬০ টাকা না হয়। এখনও বিপিসি’র ডিজেল আমদানির খরচ ১২২ টাকা লিটার। আর সেটা আমরা ১১৪ টাকায় বিক্রি করছি। এখনও লসেই জ্বালানি বিক্রি করছি আমরা।
এদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে জ্বালালি তেলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ।
সংগঠনটি তাদের ভ্যারিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে জানায়, আওয়ামী লীগ সরকার সব সময় জনগণের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। যতদিন সম্ভব ছিল ততদিন সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির চিন্তা করে নাই। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে অবস্থার প্রেক্ষিতে অনেকটা নিরুপায় হয়েই জ্বালানি তেলের মূল্য অ্যাডজাস্টমেন্টে যেতে বাধ্য হচ্ছে সরকার।
আওয়ামী লীগ জানায়, ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে দিয়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের মূল্য রি-এডজাস্টমেন্ট করবে সরকার।
বাংলাদেশ পেট্টোলিয়াম কর্পোরেশন বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রয়ে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে।
বর্তমানে, আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মূল্য সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছে সরকার ।
এশিয়ার জন্য জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ালো সৌদি
এদিকে এশিয় ক্রেতাদের জন্য রেকর্ড মাত্রায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সৌদি আরব। নতুন মূল্য আঞ্চলিক বেঞ্চমার্কের চেয়ে ৯ দশমিক ৮০ ডলার বেশি। সৌদির রাষ্ট্রায়ত্ত উৎপাদক আরামকো তাদের আরব লাইট গ্রেড ক্রুডের দাম বাড়িয়েছে।
ব্লুমবার্গের এক জরিপে জ্বালানির দাম দেড় ডলার বাড়ার সম্ভাবনার কথাও বলা হয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ জ্বালানি তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরবকে তেল উৎপাদন বাড়াতে ব্যাপক চাপ প্রয়োগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সৌদি ও রাশিয়া নেতৃত্বে থাকা জ্বালানি তেল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক ২৩ দেশের জোট ওপেক প্লাসের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তিন আগস্ট।
জোটের ভাষ্য, তারা পশ্চিমা চাপের মুখেও জ্বালানি পণ্য সরবরাহ বাড়িয়ে দর কমাতে চায় না। তার একদিন পরই এশিয়ার জন্য জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সৌদি আরব।
বিশ্ব ও বাংলাদেশের তুলনামূলক চিত্র
নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের লিটার ৮০ থেকে ১১৪ টাকা, অকটেনের লিটার ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা, পেট্রোলের লিটার ৮৬ থেকে করা হয়েছে ১৩০ টাকা।
ভারত
প্রতিবেশী দেশটিতে বর্তমানে অকটেনের দাম প্রতি লিটার ১০৬ রুপি। বাংলাদেশের মুদ্রায় ১৩৭ টাকা ৮০ পয়সা। আর পেট্রোল ১৩৬ টাকা ও ডিজেল ১২০ টাকা।
ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর আগে অর্থাৎ দুই মাস আগেও ভারতের বাজারে সব জ্বালানি তেলের দাম ছিল অন্তত ১০-১২ টাকা করে কম। তবে পরে দাম সমন্বয় করে মূল্যবৃদ্ধি করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রে গত কয়েকমাসে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে পেট্রোল কিনতে ব্যয় হচ্ছে ৫ ডলার। কোথাও কোথাও আরও বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর দাম ১৩৫ টাকা। যা দুই মাস আগেও ছিল ১০০ টাকার নিচে। দামের এই ঊর্ধ্বগতির কারণ হিসেবে দেশটির প্রশাসন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে দায়ী করেছেন। দেশটি এই মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে পারছে না।
দক্ষিণ কোরিয়া
দুই মাস আগে দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রতি লিটার ডিজেল বিক্রি হতো ১ ডলারের নিচে অর্থাৎ ১০০ টাকা করে। পরে দাম বৃদ্ধি করে ১.৫ ডলার করা হয়। এতে বাংলাদেশের মুদ্রায় ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ১৪৪ টাকায়।
অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়াতে গত কয়েকমাসে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটিতে বর্তমানে প্রতি লিটার পেট্রোল কিনতে ব্যয় হচ্ছে ২ ডলার। বাংলাদেশের মুদ্রায় প্রায় ১৫০ টাকা করে। আর ডিজেলের দাম ১৬০ টাকা করে।
যা দুই মাস আগেও ছিল ১২০ টাকার মধ্যে। মূলত ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে দামের এই ঊর্ধ্বগতি।
ফ্রান্স
ইউক্রেনে অভিযানের আগে দেশটিতে পেট্রোল বিক্রি হতো ১ ইউরো ৪০-৫০ সেন্ট ও অকটেন ১ ইউরো ৬০-৭০ সেন্ট করে অর্থাৎ বাংলাদেশি মুদ্রায় এর দাম যথাক্রমে ১৫০-১৬০ টাকা ছিল।
তবে যুদ্ধের প্রভাবে ফ্রান্সে এখন প্রতিলিটার অকটেনের দাম ১ ইউরো ৯৬ সেন্ট। বাংলাদেশের মুদ্রায় অকটেনের দাম এখন ২২০ টাকা, পেট্রোল ২৩২ ও ডিজেল ২২৪ টাকা।
জার্মানি
দেশটিতে বর্তমানে প্রতি লিটার ডিজেলের দাম ১ ইউরো ৮৯ সেন্ট। বাংলাদেশের মুদ্রায় ১৮৯ টাকা। তবে দুই মাস আগেও সেখানে দাম ছিল ১ ইউরো ১০-১৫ সেন্ট। বাংলাদেশের মুদ্রায় ১১৫ টাকা। পেট্রোল ১৭৫ টাকা।
এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন-নেপালে ডিজেল প্রতি লিটার ১২৭ টাকা, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩৮, সিঙ্গাপুরে ১৮৯, চীনে ১১৮, আরব আমিরাতে ১২২.৮০ এবং হংকংয়ে ২৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য দেশ অনেক আগেই তাদের জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে। আর বাংলাদেশ সরকার ভর্তুকি দিয়ে এসেছে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্যও অপেক্ষা করেছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বিগত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি ২২ থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত) জ্বালানি তেল বিক্রিতে ৮০১৪.৫১ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ভাষ্যমতে, বর্তমানে, আন্তর্জাতিক তেলের বাজার পরিস্থিতির কারণে বিপিসির আমদানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে মূল্য সমন্বয় করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
একাত্তর/এসি