গত পাঁচ বছরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রাকৃতিক বা মিথেন গ্যাস বিস্ফোরণের ১০০টিরও বেশি ঘটনা ঘটেছে। যাতে মানুষও মারা গেছে শতাধিক। শুধু রাজধানীর সিদ্দিকবাজার ও মগবাজারেই মারা গেছে ৩৮ জন মানুষ।
এসব তথ্য বিস্ফোরণ নিয়ে কাজ করা পুলিশের বিশেষায়িত দল বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের। তাদের তদন্ত বলছে, এসব বিস্ফোরণের আগে সাধারণ মানুষ বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমা হাবার বিষয়টি বুঝতেই পারেনি।
কিন্তু ১৯৯১ সালে তৈরি করা প্রাকৃতিক গ্যাস নিরাপত্তা বিধিমালায় বলা হয়েছে, বাসা বাড়িতে গ্যাস সরবরাহের আগে অবশ্যই বিশেষ গন্ধ যুক্ত করতে হবে, যাতে করে গ্যাস বের হলে সবাই বুঝতে পারে। কিন্তু এখন গ্যাস থেকে সেই গন্ধ আর পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কি গন্ধ আর ব্যবহার করছে না কর্তৃপক্ষ? না করলে কেন করছে না?
২০২১ সালের ২১ জুন রাতে মগবাজারে বেঙ্গল মিটের একটি দোকানে ভয়াবহ বিস্ফোরণে মারা যায় ১২ জন। এরপর ২৩ সালের ৭ মার্চ সিদ্দিকবাজারে এক মুহূর্তের বিস্ফোরণে ধসে পড়ে একটি সাততলা ভবন। মারা যায় ২৬ জন। পুলিশের তদন্ত বলছে, দুটি ঘটনার পেছনেই কারণ ছিলো তিতাসের লাইন থেকে জমা হওয়া গ্যাস।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার রহমত উল্লাহ চৌধুরি বলেন, গেলো পাঁচ বছরে গ্যাসের কারণে এমন বিস্ফোরণ হয়েছে শতাধিক। মৃত্যুও হয়েছে শতাধিক।
গ্যাসের বের হবার কারণে আগুন লাগতে পারে। কিন্তু বোমার মতো ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেন হয়? এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমরা যাই, বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগে।
অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত জানান, মিথেন গ্যাস অন্য গ্যাসের চেয়ে হালকা। তাই বদ্ধ ঘরের লাইনে খুব ছোট কোনো ছিদ্র থাকলেও সেই গ্যাস ঘরের ছাদ বরাবর জমা হয়। দীর্ঘদিন ধরে এটি জমতে জমতে যখন ঘরের মধ্যে থাকা মোট বায়ুর মাত্র ৫ থেকে ১৫ শতাংশ মিথেন গ্যাস হয়, সেটি সামান্য স্ফুলিঙ্গেই বোমার মতো বিস্ফোরণ ঘটায়।
বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগের এ অধ্যপক আরও জানান, অতি দাহ্য পদার্থের কারণে কোথায় যদি ফ্লেমেবল মিক্সচার তৈরি হয়। যেকোনো জায়গা থেকেই এনার্জিতা আসতে পারে এবং বিস্ফোরণ হতে পারে।
প্রাকৃতিক গ্যাস গন্ধহীন। তাই ১৯৯১ সালে তৈরি করা প্রাকৃতিক গ্যাস নিরাপত্তা বিধিমালার ৭৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে বাসা বাড়িতে গ্যাস সরবরাহের আগে অবশ্যই বিশেষ একটি গন্ধ যুক্ত করতে হবে। যাতে গ্যাস বের হলে সহজেই সেটি বোঝা যায়। কিন্তু এসব বিস্ফোরণের আগে কি কেউ কোনো গন্ধ টের পেয়েছিলেন?
সিটিটিসি'র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, কেউ কোনো গন্ধ পেয়েছেন বা শনাক্ত করতে পেরেছেন বলে আমরা কোনো তথ্য পাইনি।
তিতাস কি তাহলে গ্যাসে এই গন্ধ যুক্ত করছে না? এ নিয়ে অনুসন্ধানে এগিয়ে আসে বুয়েটের রাসায়নিক প্রকৌশল বিভাগ। যে রাসায়নিক মিশিয়ে গ্যাসে গন্ধ যুক্ত করা হয় তার নাম মারকেপটেন। গ্যাসে সেটির উপস্থিতি আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করতে জাপান থেকে আনা হয় মারকেপটেন ডিটেকশন টিউব।
প্রাকৃতিক গ্যাসে আসলে কোন গন্ধ নাই, এজন্যই মারকেপটেন নামের একটি রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়।
তিতাস তাদের গ্যাসে কোনো গন্ধকারক ব্যবহার করছে কিনা সেটি পরীক্ষার জন্য বুয়েটের গবেষকদের নিয়ে আমরা যাই মগবাজারে। যে ভবনে ২০২১ সালে বিস্ফোরণ হয়েছিল; তার উল্টো পাশের একটি ভবন থেকে আমরা গ্যাসের নমুনা সংগ্রহ করি।
সেখানকার বাসিন্দারা জানান, মগবাজারের সেই বিস্ফোরণ তাদের কতটা আতঙ্কগ্রস্ত করেছিল।
মগবাজারের দিলু রোডের আরেকটি বাসা থেকেও নেয়া হলো গ্যাসের নমুনা। এরপর যাওয়া হয় মোহাম্মদপুর ও কল্যাণপুর।
এসব বাসার বাসিন্দারা সবাই বলছেন, তারা কখনোই গ্যাসের কোনো গন্ধ পান না।
নমুনাগুলো নেয়া হলো বুয়েটের ল্যাবে। প্রতিটি নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেলো কোনোটিতেই গন্ধ সৃষ্টিকারী মারকেপটেনের কোনো অস্তিত্ব নেই।
বুয়েটের ল্যাবে সংযুক্ত তিতাসের লাইন থেকেও সরাসরি গ্যাস নিয়েও মারকেপটেনের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি।
এবার ল্যাবে থাকা একটি এলপিজি সিলিন্ডার থেকেও নমুনা নেয়া হলো। এই নমুনায় অবশ্য খুব অল্প গ্যাসে অল্প সময়ের জন্য মারকেপটেনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।
বুয়েট অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত বলেন, গ্যাসের টিউবের রং হলুদ। যদি এখানে মারকেপটেন থাকে তাহলে এটি বদলে লালচে হয়ে যাবে। আমরা আজকে চারটি প্রাকৃতিক গ্যাস ও একটি এলপিজি'র নমুনা পরীক্ষা করেছি। এলপিজি'র নমুনা পরীক্ষায় আমরা দেখেছি রং বদলে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা শহরের বিভিন্না জায়গা থেকে সংগ্রহ করা চারটি প্রাকৃতিক গ্যাসের নমুনায় কোনো রং পরিবর্তন হয়নি। আমরা গন্ধটাও পাচ্ছি না।
বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে দ্বিতীয় দিন বুয়েটের গবেষকদের নিয়ে যাওয়া হয়, ধানমন্ডি ও পুরনো ঢাকার আগামাসি লেনের দুটি বাড়িতে। এবার ব্যাগে করে গ্যাস না এনে সরাসরি টিউব লাগিয়ে পরীক্ষা করা হলো। এখানেও গন্ধ সৃষ্টিকারী রাসায়নিক মারকেপটেনের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি।
ঠিক পাশের ভবনেই এলপিজি'র হাব তৈরি করে গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছিল। সেই ভবনের এলপিজি থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় অবশ্য মারকেপটেনের অস্তিত্ব ও গন্ধ পাওয়া যায়।
কুমিল্লা জেলাটি বাখরাবাদ গ্যাস সরবরাহ কোম্পানির অধীনে। শহরের কান্দিরপাড় ও আদালত পাড়ার দুটি বাড়িতে গ্যাসের পরীক্ষা করে খুব অল্প মাত্রার মারকেপটেনের অস্তিত্ব মেলে। তবে নাকে গন্ধ পাওয়া যায় না।
বুয়েটের গবেষক আফিক মোহাম্মদ সাদ বলেন, এখানকার প্রাকৃতিক গ্যাসে মারকেপটেন থাকলেও তা খুবই সামান্য।
এবার আমরা যাই রাখারাবাদের অধীনে থাকা ফেনী শহরে। এই শহরের একটি বাসায় ৪ মাস আগেই একটি বিস্ফোরণের ঘটে।
এখানেও কোনো গন্ধ মেলেনি। সরেজমিন দেখা যায়, বাসার পুরোনো গ্যাস লাইনের পাশে এখন নতুন একটি লাইন করা হয়েছে। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জানান, গ্যাস কর্তৃপক্ষের পরামর্শে তারা নতুন পাইপ লাগিয়েছেন। কিন্তু কখনোই গ্যাসের কোনো গন্ধ তারা পাননি।
এবার দেশের দ্বিতীয় বড় শহর চট্টগ্রাম। এই শহর কর্ণফুলি গ্যাস সরবরাহ কোম্পানির অধীনে। আগ্রাবাদ ও খুলশীর দুটি বাসার গ্যাস পরীক্ষা করেও কোনো গন্ধ সৃষ্টিকারী উপাদান মেলেনি। একইভাবে পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস সরবরাহ কোম্পানির অধীনে থাকা সিরাজগঞ্জেও মারকেপটেনের অস্তিত্ব মেলেনি।
গ্যাস বিপণনের মোট ছয়টি কোম্পানির মধ্যে জালালাবাদ ও সুন্দরবন ছাড়া বাকি চারটি কোম্পানির ১৩টি স্থানের গ্যাসের ওপর চালানো পরীক্ষায় কেবল বাখরাবাদ কোম্পানির অধীনে থাকা কুমিল্লায় খুব সামান্য গন্ধকারকের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও ফেনীতে সেটি পাওয়া যায়নি। অন্য তিনটির কোম্পানি তিতাস, কর্ণফুলী ও পশ্চিমাঞ্চলেও কোনো গন্ধ সৃষ্টিকারী উপাদান মেলেনি।
ডেমরার সিটি গেইট স্টেশন থেকে রাজধানীর গ্যাস সরবরাহ করা হয়। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গন্ধ সৃষ্টিকারী উপাদান মারকেপটেনের জন্য একটি ট্যাংক আছে। কিন্তু সেটি চালু নেই।
ট্যাংকটির বাইরে থাকা স্কেলে দেখা যায় ভেতরে মারকেপটেন তলানিতে পড়ে আছে।
তিতাসের দাবি অনুযায়ী, গন্ধকারক মেশালে কেন গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না সেই প্রশ্নে তিতাসের ম্যানেজারের আমিনুর রহমান তালুকদার বলেন, বর্তমানে এটা অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত হারে দেয়া হয়। যার ফলে, অনেকে বুঝতে পারে না।
২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাসের গন্ধ পেয়ে নানা এলাকায় আতঙ্ক ছড়ায়। সে সময় তিতাস দাবি করেছিল গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে এমনটা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো সেদিনই যথাযথ মাত্রায় মারকেপটেন ব্যবহার করেছিল তিতাস। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ লাইনে এতো বেশি ছিদ্র যে এতে শহরজুড়ে গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও সেটি স্বীকার করে বলেন; আতঙ্ক এড়াতে এখন তারা গন্ধকারক কম ব্যবহার করছেন।
তিতাস ব্যবস্থাপনা পরিচালক হারুনুর রশিদ মোল্লাহ বলেন, আমাদের পাইপলাইনগুলো ৬০/৭০ বছরের পুরোনো। পাইপে কিছু কিছু ছিদ্র রয়েছে, চাপ বাড়লে সেখান দিয়ে গ্যাস বের হয়। মারকেপটেন দেয়া হচ্ছে কিন্তু বেশি দেয়া হচ্ছে না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল আলম বলেন, এখানে চাপ বেশি হলে গ্যাস লিক হয়, আর চাপ কম থাকলে লিক হয় না। তার মানে, লিক হয়। ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেম দিয়ে গ্যাস সার্ভিস দিচ্ছে। জীবন বিপন্ন করে ফেলেছে। কতবড় দায়বদ্ধতার ওপরে উঠলে এই কাজতা করতে পারে?
তিনি আরও বলেন, আমরা দাবি করে আসছি যে, এই মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে অবহিত করতে হবে। এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যারা জড়িত তাদের নাম আসতে হবে।
সরকারের করা বিধিমালায় গন্ধ ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু বিপণন কোম্পানিগুলোর এমন দায়হীন আচরণের কারণে জননিরাপত্তা এখন চরম হুমকিতে।
গন্ধ নাই, তাই ছিদ্রও নাই, তাই গ্যাস লিকেজের কোনো দায়ও নাই। এই নীতির কারণে আমরা যে কত বড় ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছি তা আন্দাজও করতে পারছি না।
সিদ্দিকবাজার, মগবাজার, সাইন্সল্যাব, ফেনীর মতো অসংখ্য ভয়াবহ ঘটনার পরও জননিরাপত্তার কথা চিন্তা করে গ্যাস কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি।
পুলিশের অভিযোগ, মগবাজার ও সিদ্দিক বাজারের ঘটনায় করা মামলার তদন্তে তিতাস কোনো সহযোগিতাও করছে না। হয়ত এই মুহূর্তেও কোথাও তৈরি হচ্ছে নতুন কোনো গ্যাস চেম্বার, ছোট একটা স্ফুলিঙ্গ আবারো কেড়ে নিতে পারে বহু প্রাণ।