ফরিদপুর-২ আসনেও সব দলে একাধিক প্রার্থীর ছড়াছড়ি। একটা সময় সালথা ও নগরকান্দা নিয়ে গঠিত এই আসনটিকে নিজেদের ঘাঁটি দাবি করতো বিএনপি। যদিও আলোচিত নির্বাচনে জয়ের ধারায় আওয়ামী লীগ-বিএনপি সমান সমান।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, এখানে নৌকার ভোট সব সময় বেশি। কিন্তু কোন্দলের কারণে ভোট ভাগ হয়ে যায়। আর বিএনপি সব সময় এই সুযোগটাই নেয়।
ফরিদপুর-২ আসনভুক্ত দুটি উপজেলার অর্থনীতিই কৃষি নির্ভর। পাট ও পেঁয়াজের রাজধানী খ্যাত এই দুই উপজেলার মানুষে দীর্ঘ দিনের দাবি কৃষি পণ্যের মূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি পেঁয়াজের সংরক্ষণাগার গড়ে তোলা। তবে ভোটারদের অনেকেই মনে করেন, উন্নয়ন বিবেচনায় সরকারের ধারাবাহিতা থাকা দরকার।
এই আসনের অভিভাবক বলে বিবেচিত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর মৃত্যুর পর এখানে দলীয় কোন্দল দিন দিন প্রকাশ্য হচ্ছে। তার ছোট ছেলে বর্তমান সংসদ সদস্য শাহদাব আকবর চৌধুরী লাবুর সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক সম্পাদক ও নগরকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জামাল হোসেন মিয়া। এছাড়াও মনোনয়ন চান আরও কমপক্ষে ছয় নেতা।
নগরকান্দা-সালথা-কৃষ্টপুর ইউনিয়ন নিয়ে এ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য ও প্রয়াত সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কনিষ্ঠ পুত্র শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী তার মায়ের খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা কাজে লাগিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে চান।
অন্যদিকে, ব্যাপক প্রচারে এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন জামাল মিয়া। গেলো উপনির্বাচনে প্রার্থী হতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছিলেন জামাল মিয়া। সে সময় তার পক্ষে আসনের বেশিরভাগ নেতা-কর্মী সমর্থন দিয়েছিলেন। পরে দলের হাইকমান্ডের নির্দেশে জামাল মনোনয়নপত্র তুলে নেন। আগামী নির্বাচনে তিনি দলের পক্ষে মনোনয়ন চাইবেন বলে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে ঘোষণা দিয়েছেন।
এছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি আ ত মা হালিম, জেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুজ্জামান চৌধুরী জুয়েল, বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ মিয়া।
এদিকে বিএনপির সাবেক মহাসচিব, স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেকমন্ত্রী কে এম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ইসলাম রিংকু আগামী নির্বাচনে এ আসনে প্রার্থী হতে পারেন বলে অনেকটাই নিশ্চিত দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীরা।
এছাড়া জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল। বিএনপির এ দুই শীর্ষ নেতা এলাকায় থেকে নানা কর্মসূচি পালন করছেন।
জেলা বিএনপির সদস্য সচিব একেএম কিবরিয়া স্বপন মনে করেন, এই আসনে বিএনপির প্রার্থীরা যথেষ্ট শক্তিশালী। এখানে এক সময় বিএনপির একক আধিপত্য ছিলো কে এম ওবায়দুর রহমানের। এবার এখানে তার মেয়ে শ্যামা ওবায়েদের নির্বাচন করার কথা রয়েছে।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী খন্দকার নুরুল ইসলাম, ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে জাসদের প্রার্থী আব্দুল মতিন মিয়া, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী এ কে এম খায়রুজ্জামান মিয়া, ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে একই দলের সাইফুজ্জামান চৌধুরী জুয়েল নির্বাচিত হন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সাজেদা চৌধুরী, ১৯৯৬ সালের একতরফা নির্বাচনে বিএনপির আবুল হোসেন মিয়া, ১৯৯৬ সালের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কে এম ওবায়দুর রহমান, ২০০১ সালের নির্বাচনে কে এম ওবায়দুর রহমান, ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাজেদা চৌধুরী বিজয়ী হন।
২০২২ সালে তার মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হলে উপনির্বাচনে তার ছেলে শাহদাব আকবর লাবু চৌধুরী সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে বর্তমানে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
এলাকার সাধারণ ভোটারদের দেওয়া তথ্য মতে, ওবায়দুর রহমানের মৃত্যুর পর এই আসনটিতে বিএনপির ‘দাপট’ অনেকটাই কমে এসেছে। পাশাপাশি সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরীও প্রয়াত হয়েছেন কিছুদিন আগে। তাই আওয়ামী লীগের অবস্থানও যে খুব শক্ত সেটা বলা যাচ্ছে না।
তাদের মতে, এবারের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিএনপি নির্বাচনে আসার ঘোষণা দিলে বদলে যেতে পারে হিসাব-নিকাশ। আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে ভোটের লড়াইয়ে নামতে হবে। কে এম ওবায়দুর রহমানের উত্তরসূরি শামা ওবায়েদকে মোকাবিলা করা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে সহজ হবে না।
বিরোধী শিবিরে নানা সমালোচনা থাকলেও সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী পরিবেশ ও বনমন্ত্রী এবং পরবর্তী সময়ে টানা তিন বার সংসদ উপনেতা থাকায় এ আসনে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিকভাবে দলের শক্ত ভিত তৈরি করেছেন। তার মৃত্যুর পর ছেলে লাবু চৌধুরী এমপি নির্বাচিত হয়ে উন্নয়ন অব্যাহত রেখেছেন।
এদিকে ২০০৭ সালে কে এম ওবায়দুর রহমান মারা যাওয়ার পর উত্তরাধিকর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন তার ভাই কে এম জাহাঙ্গীর, স্ত্রী শাহেদা ওবায়েদ এবং কন্যা শামা ওবায়েদ। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ছিনিয়ে আনার লড়াইয়ে জয়ী হন শামা ওবায়েদ। মেয়ের কাছে মনোনয়ন লড়াইয়ে হেরে বিএনপির রাজনীতি থেকে বিদায় নেন শাহেদা ওবায়েদ।
এরপর ২০১৩ সালে চাচা কে এম জাহাঙ্গীরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়ান শামা ওবায়েদ। এই দ্বন্দ্বের জের ধরে ২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর নগরকান্দা উপজেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জাহাঙ্গীর দল থেকে বহিষ্কার হন। ঢাকা থেকে রুহুল কবির রিজভী এক পত্রের মাধ্যমে তাকে বহিষ্কার করেন। একে একে ঘরের শত্রুকে পরাস্ত করে শামা ওবায়েদই এখন ফরিদপুর-২ আসনে বিএনপির কাণ্ডারী।
শামা ওবায়েদ ছাড়াও বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের সদস্য সচিব শহীদুল ইসলাম খান বাবুলও আলোচনায় আছেন। তবে শামা ওবায়েদকে বাদ দিয়ে শহীদুল ইসলাম খান বাবুলকে ধানের শীষ প্রতীক দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম- এমনটিই বলছেন নগরকান্দা, সালথা ও সদরপুরের কৃঞ্চপুর ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ নেতা-কর্মী সমর্থকরা।
একাত্তর/এসি