শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়েসি মানুষের কাছে ভূত নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। কেউ বলেন ভূত দেখেছেন, চোখে না দেখলেও অনেকেই নিজেদের নানা ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলেন। ভূত নিয়ে আলোচনা-গল্প শুরু হলে অনায়াসেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা শেষ হয়ে যেতে পারে! মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষ ভয় পেতে ভালোবাসে। তাই ‘ভূত’ বা যে কোনও ‘ভৌতিক’ কার্যকলাপ নিয়ে মানুষের আকাশছোঁয়া কৌতূহল।
তাই ভূত নিয়ে যেমন আছে হাজারো হাজারো গল্প-উপন্যাস, তেমনি তৈরি হয়েছে অনেক সিনেমা। আর ভূত নিয়ে টিভি সিরিয়ালের সংখ্যা যে কত, তার হিসাবে নেই। বন্ধু বা পরিবারিক কোন আড্ডায় ভূতের অভিজ্ঞতা প্রিয় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রাতে অশরীরী কণ্ঠস্বর, অদ্ভুত দর্শন কিছু, নিজে থেকেই নড়াচড়া করছে টেবিল-চেয়ার, টেবিল থেকে বই পড়ে যাচ্ছে। এমন ভুতুড়ে কথা প্রায়ই শোনা যায়, যার কোনো ব্যাখ্যা হয় না।
ছোটোবেলায় নানা-নানী, দাদা-দাদীর কাছে ভূতের গল্প শুনতে সব শিশুই ভালোবাসে। আর ভূত শিশুর মনে গেঁথে যায়। সব সময়েই অবচেতন মনে ভূতের ভয় কাজ করে। এই ভয়ের মধ্যেও যেন এক ধরনের মজাও আছে। ভূত দেখেছেন এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়! কিন্তু আসলেই কি ভূত আছে, তারা কোথায় থাকে, তাদের কি কোন দেশ আছে? আর ভূত নিয়ে বিজ্ঞানই বা কি বলছে।
বিজ্ঞানের কাছে রাতে বট গাছে বিশাল লম্বা সাদা মানুষ দেখা, কবরস্থানের পাশ দিয়ে চলার সময় ঘাড় মটকে দেয়া সবই কল্পনা। এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। বিজ্ঞান মনে করে ভূতের অস্তিত্ব নেহাত একটি কাল্পনিক ব্যাপার। ভূত দেখার ঘটনা মন বা চোখের বিভ্রম ছাড়া কিছুই না। যদি আমাদের মন ও চোখ কোন কিছুকে গুরুত্ব না দিয়ে ভিন্ন কিছু দেখতে বা ভাবতে চায়, তাহলে কোন বস্তুকে অবিকল দেখতে নাও পারি।
বিজ্ঞানী এবং গবেষকরা সম্প্রতি এমন চমকপ্রদ কিছু বিষয় আবিষ্কার করেছেন, যা হয়তো বা ব্যাখ্যা দিতে পারবে, মানুষ কেন মনে করে যে, সে ভূত দেখেছে। লন্ডনের গোল্ডস্মিথস বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানোম্যালিস্টিক সাইকোলজি রিসার্চ ইউনিটের প্রধান ড. ক্রিস ফ্রেঞ্চ ভূত দেখার গল্পের পেছনের কারণ হিসেবে স্লিপ প্যারালাইসিসকে তুলে এনেছেন, যেটাকে বাংলায় কেউ কেউ ‘বোবায় ধরা’ বলে থাকেন।
মানুষ যখন তার ঘুমের একটা বিশেষ পর্যায়, ‘র্যাপিড আই মুভমেন্টে’ পৌঁছায়, তখন আর মস্তিষ্ক শরীরকে নড়াচড়ার সংকেত পাঠায় না। আর ঠিক এ সময়টায় মানুষ কখনো জেগে উঠলেও নড়াচড়া করতে পারে না। স্লিপ প্যারালাইসিসের আরও কিছু লক্ষণ হল, মনে হবে কেউ ঘরে আছে অথবা আপনাকে চেপে ধরে আছে। আর যেহেতু এ সময়টায় মানুষ সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখে তাই, হ্যালুসিনেশন বা দৃষ্টিবিভ্রম হতে পারে।
ড. ক্রিস জানান, স্লিপ প্যারালাইসিস হল স্বাভাবিক ঘুমের প্রক্রিয়ায় এক ধরনের ত্রুটি। এই ত্রুটি মাঝেমধ্যে ভয়ঙ্করও হতে পারে। স্লিপ প্যারালাইসিসের ক্ষেত্রে হ্যালুসিনেশনের বিষয়টি ‘শতকরা খুব সামান্য’ পরিমাণে উঠে আসে। কিন্তু যেহেতু স্লিপ প্যারালাইসিস অনেকের মাঝেই দেখা যায়, তাই সেই ‘শতকরা খুব সামান্য’ হ্যালুসিনেশন অনেক মানুষকে ভূত দেখায়। অর্থাৎ, ভূত দেখার মতো অভিজ্ঞতা হয় অনেকের।
আবার সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট অধ্যাপক স্টিফেন হুপ বলেন, ভূত দেখার একটি সাধারণ কারণ প্যারিডোলিয়া হতে পারে। এটি হলো মস্তিষ্কের অস্পষ্ট উদ্দীপনার মধ্যে অস্পষ্ট প্যাটার্ন, মানুষের মুখ-শরীরের অবয়ব খুঁজে পাওয়ার প্রবণতা। এটিকে অপোফেনিয়ার প্রভাব বলা যেতে পারে। এই অপোফেনিয়া হল সম্পর্কহীন জিনিসের মধ্যে অর্থপূর্ণ সংযোগ বা কাল্পনিক অবয়ব গড়ে তোলার প্রবণতা।
ডক্টর ক্রিস বলেন, যেসব মানুষ মনে করে তারা ভূত দেখেছে তাদের সেই চিন্তার পেছনে তিনটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকে, এক- পূর্ব বিশ্বাস দুই- পারিপার্শ্বিক অবস্থা, এবং তিন হ্যালুসিনেশন। ভূত শব্দ শোনা মাত্রই এক ধরনের অনুভূতিতে আক্রান্ত হয় মানুষ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভয় বা সতর্কতার অনুভূতি। ইন্দ্রিয়গুলো অনেক বেশি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। ভূত শব্দটা শোনা মাত্রই ভিন্ন কিছু দেখার প্রবণতাও তৈরি হয়।
তিনি বলেন, হ্যালুসিনেশন তো খুবই স্বাভাবিক। যে কারো দীর্ঘ দিন ধরে ঠিকমতো ঘুম না হলে, অত্যধিক মানসিক চাপ বা উচ্চ তাপমাত্রায় এটা হতে পারে। হ্যালুসিনেশন বা বিভ্রমের সময় মানুষ প্রায়ই জিনিসপত্র অবিকলভাবে দেখতে না পাওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়ে থাকে। পারিপার্শ্বিক অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ। পুরোনো দিনের বাড়ি বা রাজপ্রাসাদের নাম শুনলেই মনে হয় প্রেতাত্মার কথা, অশরীরী অতৃপ্ত আত্মার ঘোরাফেরা।
অধ্যাপক স্টিফেন হুপের মতে, একজন ব্যক্তির মৃত্যুর পর, তার শরীরের শক্তি পরিবেশে মিশে যায়। শক্তি তাপ আকারে নিঃসৃত হয় এবং শরীরটি ধীরে ধীরে প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়। এমন কোনও শারীরিক শক্তি বা আত্মা নেই, যা মৃত্যুর পরেও জনপ্রিয় ঘোস্ট-হান্টিং যন্ত্রের মাধ্যমে শনাক্ত করার জন্য টিকে থাকে। কৃত্রিম ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি করেও মানুষের মধ্যে বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন তৈরি করা যায়।
সমাজবিজ্ঞানী ডেনিস ও মিশেল ওয়াসকুল তাদের ‘ঘোস্টলি এনকোউন্টার্স: দ্য হন্টিংস অফ এভরিডে লাইফ’ বইতে দেখিয়েছেন, যারা ভূত দেখেছেন বলে দাবি করে, তাদের কেউই কি ঘটেছে সেটি বলতে পারে। তবে তারা একটা বিষয়ে নিশ্চিত যে, তারা এমন কিছু অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা পেয়েছেন, যা ব্যাখ্যাতীত, রহস্যময় বা ভয়ঙ্কর কিছু। আর এসব কেন হয় তার ব্যাখ্যা অনেক আগেই দিয়েছে বিজ্ঞান। আসলে ভূত বলে কিছু নেই।