স্থলপ্রাণীদের মধ্যে দ্রুততম প্রাণী হিসেবে চিতা বিখ্যাত। গবেষণা বলছে, শুধুমাত্র গতি ছাড়াও অনেক বিষয় আছে, যা দৌড়বিদরা চিতা থেকে রপ্ত করতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দৈহিক ওজন, পেশি শক্তি ও তীক্ষ্ণ নখ।
ধরুন একটি ইমপালা (মাঝারি আকারের হরিণ) আফ্রিকার কোনো এক মরুতে চিতার ধাওয়া খেয়ে পালানোর জন্য দৌড়াচ্ছে। যার গতি ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল)।
এ অবস্থায় শুরুতে আপনার মনে হতে পারে, আশাহীন চেষ্টা। কিন্তু বাস্তবে কখনো কখনো হরিণ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিশ্বের দ্রুততম এই প্রাণীকে ছাড়িয়ে যেতে কী কৌশল অবলম্বন করে হরিণ।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল ভেটেরিনারি কলেজের লোকোমোটর বায়োমেকানিক্সের অধ্যাপক অ্যালান উইলসন ও তার টিম, চিতাদের খেলাধুলা ও দৌড়ের বেশ কিছু ছবি প্রকাশ করেছে। তারা চিতাদের গতি এবং নড়াচড়া পরিমাপের জন্য বিশেষ এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করেন।
গবেষক দল বিমান থেকে চিতাদের গতি পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি মৃত চিতাদের টিস্যুও পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন।
পরে তারা নিশ্চিত হয়েছেন, শুধুমাত্র গতি ছাড়াও অনেক ধরনের পন্থা চিতা দৌড়ের সময়ে অবলম্বন করে। এরা দৌড়ের সময় অনেকগুলো কাজ দ্রুত করে, যা তাদের গতি বাড়াতে সহায়তা করে।
বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী বিজ্ঞান জার্নাল ‘নেচার’ ২০১৩ সালে একটি গবেষণা প্রকাশ করে, যেখানে উইলসন এবং তার দল তিনটি নারী ও দুটি পুরুষ চিতাকে প্রায় ১৭ মাস ধরে পর্যবেক্ষণ করেন এবং ৩৬৭টি দৌড়ের তথ্য সংগ্রহ করে। ওই গবেষণার আগ পর্যন্ত চিতা নিয়ে যেসব তথ্য ছিলো তা হয় আগে থেকে ভিডিও করা ফুটেজের পর্যবেক্ষণ বা বন্য কোনো চিতার দূর থেকে নেয়া ভিডিওর পর্যবেক্ষণ ছিলো।
উইলসনদের গবেষণার তথ্যমতে, তারা দেখতে পেয়েছেন, চিতারা অত্যন্ত দ্রুত- ঘণ্টায় প্রায় ৯৩ কিলোমিটার পর্যন্ত গতিতে ছুটছে (৫৮ মাইল ঘণ্টায় বা ২৫.৯ মিটার সেকেন্ডে)। যেখানে বিশ্বখ্যাত দৌড়বিদ উসেইন বোল্টের পক্ষে সর্বোচ্চ ১২.৩২ মিটার প্রতি সেকেন্ডে দৌড়ে পার হওয়া সম্ভব।
অর্থ্যাৎ এটা নিশ্চিত, কোনো চিতা প্যারিস অলিম্পিকে দৌড়াতে গেলে- সেটি অবশ্যই স্বর্ণ জিততো।
উইলসন ও তার দলের মতে, চিতার শুধুমাত্র গতি ছাড়াও অন্য আরো কিছু উপাদান আছে এর ফিটনেসে।
তারা দেখেছেন, একটি চিতা শিকারের সময় মূলত মাঝারি গতিতেই বেশি দৌড়ায়। এটি বেশ কিছু পন্থা অবলম্বন করে বিষয়টিকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়, যেমন- দৌড়াতে দৌড়াতে গতি বাড়িয়ে দেয়া, হুট করে থেকে দ্রুত বাক নেয়া প্রভৃতি। তাদের শক্তিশালী পিঠের পেশী তাদের এসব কাজে সহায়তা করে।
চিতারা পেশীবহুল উল্লেখ করে উইলসন বলেন, লোকেরা চিড়িয়াখানায় চিতাদের যেভাবে দেখে, বন্য চিতারা তার থেকে ভিন্ন হয়। বন্য চিতার শরীরে অতিরিক্ত পেশী থাকে, এবং এগুলো যথেষ্ট মজবুত। এছাড়া এদের লম্বা পা ও বড় পিঠের পেশী থাকে।
দৌড়ের জন্য প্রাণীদের পেশী মজবুত থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা তাদের দ্রুত ছুটতে এবং বাক নিতে সহায়তা করে।
তিনি বলেন, চিতাদের নকগুলো বেশ ধারালো এবং তীক্ষ্ণ হয়ে থাকে। যা হুট করে তাদের গতি বাড়াতে বা দ্রুত থেমে যেতে সহায়তা করে।
২০১৮ সালের দিকে প্রকাশিত অন্য একটি গবেষণায় উইলসন ও তার দল সিংহ ও জেব্রার গতিও পর্যালোচনা করা চেষ্টা করেন।
সেই গবেষণায় তারা পাঁচটা চিতা ও সাতটি হরিণ এবং ৯টি সিংহ ও সাতটি জেব্রার গতি পর্যবেক্ষণ করে দেখেন, চিতা ও হরিণের গতি বেশি ছিলো। তারা মৃত প্রাণীগুলোর বায়োপসি করেও অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন, সে সময়।
প্রতিবারই দেখা গেছে, শিকারী দল (চিতা ও সিংহ) তাদের শিকারের চেয়ে বেশি দ্রুত গতির ছিলো। তাছাড়া তাদের পেশীও অনেক বেশি শক্তিশালী ছিলো, যা তাদের শিকার ধরতে সহায়তা করে।
গবেষণার সময় দেখা যায়, শিকারি প্রাণীগুলো দ্রুত তাদের শিকার কাজ শেষ করতে চেষ্টা করতো, যেহেতু শিকারের পরেই তাদের খাবার মিলতো।
উইলসন গবেষণায় উল্লেখ করেন, হরিণ বা জ্রেবার মতো প্রাণীগুলোর মারা যাওয়ার ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ সময়েই তাদের শিকার হতে দেখা যায়। বাকি ৫০ শতাংশের প্রাকৃতিক বা অন্য কারণে মৃত্যু হয়।
এ অবস্থায় কোনো ব্যক্তি যদি ভালো দৌড়বিদ হতে চান, তার ফিটনেসের দিকে নজর দিতে হবে। অনেক ধরনের শরীরচর্চা এক্ষেত্রে কাজে আসতে পারে।
ছোট দুরত্বে, শরীরের জন্য মানানসই চর্চা হাড়ের ঘণত্ব বাড়তে সহায়তা করবে।
সবশেষ গবেষক দলের মতে, ছোট আকারের প্রাণীদের পেশী কত দ্রুত সংকুচিত হয়, তা নির্ভর করে পেশীগুলোর টানের মাত্রার ওপর।
চিতা আকারের প্রাণীদের দৈহিক ওজন ৫০ কেজির মতো হতে হয়। ফলে, প্রাণীগুলো দ্রুত গতির পাশাপাশি এরা ঘণ্টায় মাইলের পর মাইল ছুটতে পারে।
বিলুপ্ত হবার পথে বণ্যপ্রাণী চিতা
২০১৬ সালের বিবিসির ভিন্ন আরেক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বজুড়ে মাত্র সাত হাজার ১০০টি দ্রুতগামী চিতা টিকে আছে। বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত এলাকার বাইরেই ৭৭ শতাংশ চিতার বসবাস এবং এ কারণে মানুষের হাতে বারবার পড়ছে এগুলো।
এছাড়াও দিন দিন মাঠ আর বনগুলো মানুষ বসতি স্থাপন ও কৃষিকাজের জন্য দখল করতে থাকায় একদিকে যেমন চিতাদের বাসস্থান কমছে, তেমনি যথেষ্ট শিকার পাচ্ছে না তারা। আর এ কারণেই বিপদে পড়ে গেছে বিশ্বের দ্রুততম এই স্তন্যপায়ী প্রজাতি।
গবেষকেরা তাই চিতাবাঘকে জরুরি ভিত্তিতে ‘নাজুক’ থেকে ‘বিপন্ন’ প্রজাতির প্রাণীর শ্রেণীতে স্থানান্তরের দাবি জানিয়েছেন। তাদের দাবি, বিশ্বে যে পরিমাণ চিতা টিকে আছে অর্ধেকের বেশি আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের ছয়টি দেশ জুড়ে বসবাস করে। এশিয়া থেকে চিতাবাঘের অস্তিত্ব প্রায় মুছেই গেছে।
তথ্য সূত্র: বিবিসি।