মধ্যপ্রাচ্যে দুঃসংবাদ। যিনি পশ্চিমাদের থরথরিয়ে কাঁপিয়ে দেন, ইসরাইলের যমদূত আবার একই সাথে ফিলিস্তিনি ভাইবোনদের পরম আস্থার জায়গাজুড়ে আছেন, তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। রোববার পাহাড়ি অঞ্চলে বিধ্বস্ত হয়েছে রাইসিকে বহনকারী হেলিকপ্টার।
বিধ্বস্ত হবার পর হেলিকপ্টারটি সম্পূর্ণ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা বিধ্বস্ত এলাকায় প্রাণের কোন খোঁজ পাননি। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় প্রেসিডেন্ট রাইসি ও তার সঙ্গীরা মারা গেছেন।
প্রেসিডেন্ট রাইসি ছাড়াও ওই হেলিকপ্টারে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসাইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান, পূর্ব আজারবাইজানে খামেনির প্রতিনিধি এবং ওই প্রদেশের গভর্নর।
ইব্রাহিম রাইসি ইরানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন খুব বেশিদিন হয়নি। তারপরও তার প্রভাব-প্রতিপত্তি অপ্রতিরোধ্য। ইসরাইলের সামনে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ইসরাইলে হামলাও চালিয়েছেন। ফিলিস্তিনিদের পরম এই বন্ধু, মুসলিম বিশ্বের শক্তিশালী নেতা ইব্রাহিম রাইসির উত্থানের রয়েছে চমকপ্রদ ইতিহাস।
তিনি সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ। সমালোচকরা বলে থাকেন, তিনি কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতা। প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হন ২০২১ সালে। নির্বাচিত হয়েই ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির আমলে ইরানে যে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে এবং অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, সেসবের মোকাবেলা করবেন তিনি। শক্ত হাতে দমন করবেন দুর্নীতিকে। শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে দেশকে গড়ে তুলবেন ইরানকে।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে দেশের বিচার বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন রাইসি। সে কারণে বিচার ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজানোর ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত রাইসি। বিশ্লেষকরা বলে থাকেন, বিচার বিভাগের প্রধান হওয়ায় তার রাজনৈতিক মতাদর্শও খুব কট্টর।
ছাত্র অবস্থাতেই আয়াতুল্লাহ খামেনির নেতৃত্বাধীন ইসলামিক বিপ্লবে অংশ নেন রাইসি। বিপ্লবের পর যোগ দেন বিচার বিভাগে। বিভিন্ন শহরের সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এই নেতা। সেসময় আয়াতুল্লাহ খামেনির কাছ থেকে নেন প্রশিক্ষণ।
২৫ বছর বয়সে তেহরানের ডেপুটি প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাইসি। এই পদে থাকার সময় ইরানের বিতর্কিত ট্রাইব্যুনাল ডেথ কমিটির চারজন বিচারকের একজন ছিলেন তিনি।
২০১৪ সালে ইরানের মহা কৌঁসুলি পদের দায়িত্ব পান রাইসি। এর দুই বছর পর আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ইরানের অন্যতম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্পদশালী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আসতান-ই কুদস্-ই রাজাভি দেখাশোনার সব দায়িত্ব তুলে দেন রাইসির হাতে। এরপর ইরানের বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর সহসভাপতি হন রাইসি। দেশটির পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করে এই বিশেষজ্ঞমণ্ডলী।
পরবর্তীতে ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও পরাজিত হন রাইসি। কিন্তু ২০১৯ সালে দেশের বিচার বিভাগের ক্ষমতাশালী পদে বসান আয়াতুল্লাহ খামেনি। এর পরই বিশেষজ্ঞমণ্ডলীর ডেপুটি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির ঘনিষ্ঠ এবং আস্থাভাজন নেতা ইব্রাহিম রাইসি।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নারীদের হিজাব আইন এবং নীতিপুলিশ নিয়ে কঠোর ছিলেনি এই নেতা। সেইসাথে ফিলিস্তিনের পক্ষে হুংকার দিয়েছেন শুরু থেকেই। ইসরাইলকে চরম শিক্ষা দিতে প্রক্সি বাহিনীর সক্রিয়তায় তার ভূমিকা অপরিসীম। পাশাপাশি অত্যাধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্র ড্রোন তৈরি করে বিশ্বনেতাদের চমকে দিয়েছেন রাইসি। সেই সাথে গোপনে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথাও বলাবলি করে আসছে পশ্চিমারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাইসির বিকল্প খুঁজে বের করা এই মুহূর্তে বেশ কঠিন। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির অত্যন্ত বিশ্বস্ত ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। কট্টরপন্থী হিসাবে রাইসির সমালোচনা থাকলেও দেশের শাসনভার শক্ত হাতে সামাল দিচ্ছিলেন। সেই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়াতে ইরানের ক্ষমতা বলয় বাড়ানোর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ইব্রাহিম রাইসি।