রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি ইউক্রেন। কিয়েভের কর্তা ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, রাশিয়ার সঙ্গে আংশিক যুদ্ধবিরতির বিষয়ে রাজি তিনি। তার এই ঘোষণার পরপরই ইউরোপজুড়ে নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ইউক্রেনের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে বিশেষ সম্মেলন ডেকেছে যুক্তরাজ্য। সৌদিতে বৈঠকে বসছেন মার্কিন ও রুশ কর্মকর্তারা। আর আবারও পুতিনের সঙ্গে কথা বলবেন ট্রাম্প।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ওয়াশিংটন ও কিয়েভের মধ্যে আংশিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে যে মতৈক্য হয়েছে তার ফলে দ্রুত বিদ্যুৎকেন্দ্র, বন্দর, রেলের উপর হামলা বন্ধ হবে। তিনি জানিয়েছেন, আমরা যতক্ষণ রাজি না হচ্ছি, যতক্ষণ আংশিক যুদ্ধবিরতি নিয়ে নথি তৈরি না হচ্ছে, ততক্ষণ সব কিছুই উড়তে থাকবে।
জেলেনস্কি জানিয়েছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে আমার খুবই ইতিবাচক, খোলাখুলি ও অর্থপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। আমরা মনে করি, অ্যামেরিকার সঙ্গে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে এবং অ্যামেরিকার নেতৃত্বের অধীনে এই বছরের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি ফেরানো সম্ভব হবে।
জেলেনস্কি বলেন, তিনি ও ট্রাম্প ঝাপোরিজিয়া পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র মার্কিন তত্ত্বাবধানে রাখা নিয়ে কথা বলেছেন। বর্তমানে রাশিয়া এটি অধিকার করে আছে। তিনি জানান, যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে থাকা ইউরোপের এই সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হতে দু’বছর সময় লাগবে। ইউরোপ ও ইউক্রেনের জন্য বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা খুব জরুরি।
সাংবাদিকদের জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন রাশিয়ার পশ্চিম কুরস্ক অঞ্চলে যতদিন ইউক্রেনের সেনা থাকবে, ততদিন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবেন না। ট্রাম্প কি মস্কোর দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন, এই প্রশ্নের জবাবে জেলেনস্কি বলেছেন, সে রকম কিছুই হয়নি। আপনারা জানেন আমি খোলাখুলি কথা বলি। সে রকম কিছু হলে আমি নিজে থেকেই বলতাম।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য
ট্রাম্প তার মালিকানাধীন ট্রুথ স্যোসালে বলেছেন, ঘণ্টাখানেক সময় ধরে জেলেনস্কির সঙ্গে আমার খুব ভালোভাবে কথা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে আমার যে আলোচনা হয়েছিল, তার ভিত্তিতে কথা হয়েছে। ইউক্রেন তাদের চাহিদা ও অনুরোধের কথা জানিয়েছে।
ট্রাম্প বলেছেন, নেতারা ঠিক পথেই আছেন। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এবং জাতীয়. নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়ালটজকে বলব, যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তার বিবরণ দিতে। আলোচনার সময় তিনি প্রস্তাব দেন, ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ইউক্রেনের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর দায়িত্ব আমেরিকা নিতে পারে। আমেরিকার অধীনে বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকলে তার সুরক্ষা নিশ্চিত থাকবে।
প্রস্তাবিত মার্কিন-ইউক্রেন খনিজ চুক্তি নিয়েও কথা হয়েছে। হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ক্যারোলিন লিভিট বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি আংশিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি।
এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেলো ইউক্রেন
জেলেনস্কি জানিয়েছেন, ইউক্রেন নতুন করে আরো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান পেয়েছে। তবে কতগুলো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তারা পেয়েছেন, তা জানাতে চাননি তিনি।
২০২৪ সালের অগাস্টে অ্যামেরিকায় তৈরি এই অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান প্রথমবার পায় ইউক্রেন। সেগুলো ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস দিয়েছিল। ২০২৫ সালে নেদারল্যান্ডস আরো এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ইউক্রেনকে দেয়। তারা মোট ২৪টি যুদ্ধবিমান, তার যন্ত্রাংশ, ক্ষেপণাস্ত্র দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, বেলজিয়াম ও নরওয়ে ৬০টিরও বেশি এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দিতে রাজি হয়েছে। যুক্তরাজ্য ও রোমানিয়া ইউক্রেনের পাইলটদের এফ-১৬-র জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
প্রস্তাবিত শান্তিরক্ষী বাহিনী নিয়ে বৈঠক
ইউক্রেনের জন্য প্রস্তাবিত শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে বেশ কয়েকটি দেশের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের একটি রুদ্ধদ্বার বেঠকের আয়োজন করেছে যুক্তরাজ্য। ২০টিরও বেশি দেশ এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে জোট গঠনকারী দেশগুলোর জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা, যুক্তরাজ্যের স্থায়ী যৌথ সদর দপ্তরে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা করবেন। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার এই বৈঠকে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মন্ত্রী লুক পোলার্ড বলেছেন যে তারা এই জোটকে বিশ্বাসযোগ্য বাহিনী হিসেবে দে্খতে চান, যা ইউক্রেনে স্থায়ী শান্তি স্থাপন এবং ইউক্রেনকে পুনর্গঠন করতে সহায়তা করবে। গত রোববার যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে দেশের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছেন।
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ১৭৫ বন্দিবিনিময়
রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে ১৭৫ বন্দিবিনিময় হয়েছে। সমঝোতার ভিত্তিতে এই বন্দিবিনিময় করে উভয় দেশ। বুধবার তারা যুদ্ধের এক অন্যতম বৃহৎ বন্দিবিনিময় করেছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে গুরুতর আহত সেনা ও যোদ্ধা ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগে রাশিয়ায় আটক রাখা হয়েছিল।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে আমরা আরও ২২ জন গুরুতর আহত ইউক্রেনীয় বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে।
মঙ্গলবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সম্ভাব্য আংশিক যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে কথা বলার সময় যে ২৩ জন আহত যুদ্ধবন্দিকে মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার মধ্যে একজনকে মুক্তি দেয়নি রাশিয়া। সেই সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি রাশিয়া।
সৌদি আরবে হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-ইউক্রেন বৈঠক
ইউক্রেনে আংশিক যুদ্ধবিরতির কারিগরি বিষয়ে কয়েকদিনের মধ্যে ওয়াশিংটন ও কিয়েভের প্রতিনিধিদল সৌদি আরবে বৈঠক করতে যাচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলাপের পর এই বৈঠকের কথা জানিয়েছেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ তিনি বলেছেন, আংশিক যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন ও আওতা বৃদ্ধির জন্য কারিগরি দিক সমাধানে আমাদের প্রতিনিধিদলকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মার্কিন ও ইউক্রেনীয় দল দ্রুতই সৌদি আরবে এক বৈঠকের আয়োজন করতে যাচ্ছেন।
এই পোস্ট দেওয়ার আগে ট্রাম্পের সঙ্গে ফোনালাপ হয়েছে জেলেনস্কির। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তার যথেষ্ট ইতিবাচক, গঠনমূলক ও স্পষ্ট আলোচনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তিনি। রুশ জ্বালানি অবকাঠামোতে হামলা বন্ধের নিশ্চয়তা দিতে কিয়েভ প্রস্তুত আছে বলে জানিয়েছেন জেলেনস্কি। মার্কিন প্রশাসনের প্রস্তাব অনুযায়ী নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি মেনে নিতেও অঙ্গীকারবদ্ধ তিনি।