কথায় আছে- রাখে আল্লাহ মারে কে। ভারতের আহমেদাবাদে বিধ্বস্ত এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজের এক যাত্রীর অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া যেন এই কথার প্রমাণ। ভাগ্যহত ফ্লাইটটির সব আরোহী মৃত্যুর খবর আসার কিছুক্ষণ পরেই খবর এলো একজন যাত্রীকে জীবিত উদ্ধার করেছে গুজরাটের পুলিশ।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পরনে রক্তমাখা জামা। প্যান্ট ছিঁড়ে গেছে। এমন এক যুবক হেঁটে বেরিয়ে আসছেন আহমেদাবাদের উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের স্থান থেকে। হাত-পা কাঁপছে তার। পরে জানা গেলো, তিনিই একমাত্র বেঁচে যাওয়া যাত্রী বিশ্বাস কুমার রমেশ।
কিভাবে তিনি বেঁচে গেলেন সেই চিত্র সামনে এনেছে বিবিসি। আহমেদাবাদের একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। সেখানেই ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই ব্রিটিশ নাগরিক বলেছেন, উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হবার পর উত্তপ্ত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটি ফাঁকা জায়গা দিয়ে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার পশ্চিম ভারতের আহমেদাবাদে উড্ডয়নের কিছুক্ষণ পরেই লন্ডনগামী বোয়িং ৭৮৭ ফ্লাইটটি যখন বিধ্বস্ত হয় তখন ৪০ বছর বয়সী রমেশ ১১-এ নম্বর সিটে ছিলেন। তিনি বলেন, আমি সেটি বেল্ট খুলে ফেলি এবং পায়ে হেঁটে সেই ফাঁক দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এসেছি।
এয়ার ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ফ্লাইটটির অন্যান্য সব যাত্রী এবং ক্রু নিহত হয়েছেন- যার মধ্যে ১৬৯ জন ভারতীয় নাগরিক এবং ৫২ জন ব্রিটিশ নাগরিক রয়েছে। এখন পর্যন্ত ২০০ জনেরও বেশি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, যদিও এটি স্পষ্ট নয় যে কতজন যাত্রী ছিলেন এবং কতজন মাটি থেকে পড়েছিলেন।
হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে রমেশ বলছিলেন, উড্ডয়নের পরপরই উড়োজাহাজের ভেতরের আলো ঝিকঝিক করতে শুরু করে। পাঁচ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যেই মনে হলো বিমানটি বাতাসে আটকে গেছে। বাতিগুলো সবুজ ও সাদা রঙের হয়ে ঝিকঝিক করতে শুরু করে। হঠাৎ করে একটি ভবনে ধাক্কা খেয়ে বিস্ফোরিত হয়।
বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনারটি বাইরামজি জিজিভয় মেডিকেল কলেজ এবং সিভিল হাসপাতালের ডাক্তারদের থাকার জন্য ব্যবহৃত একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। কিন্তু লন্ডনের লেস্টারের বাসিন্দা রমেশ বলেন, তিনি যে অংশে বসেছিলেন তা মাটির কাছে পড়ে যায় এবং ভবনের সাথে সেটি কোন সংঘর্ষ হয়নি।
তিনি আরও বলেন, যখন দরজা ভেঙে দেখলাম কিছু জায়গা আছে, তখন আমি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করলাম এবং শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে এলাম। বিমানের বিপরীত দিক থেকে, অর্থাৎ দেয়ালের দিকে কেউ বেরিয়ে আসতে পারত না, কারণ বিমানটি সেখানেই বিধ্বস্ত হয়েছিল।
দুর্ঘটনার কারণ এখনও জানা যায়নি। সংবাদ সংস্থাগুলির মতে, দুর্ঘটনাস্থল থেকে একটি ব্ল্যাক বক্স উদ্ধার করা হয়েছে, যা তদন্তকারীদের আরও তথ্য প্রদান করতে সক্ষম হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা ভিডিওতে রমেশকে একটি অ্যাম্বুলেন্সের দিকে হেঁটে যেতে দেখা গেছে।
রমেশ বলেন, তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে তিনি ধ্বংসস্তূপ থেকে জীবিত বেরিয়ে এসেছেন। আমি আমার চোখের সামনে মানুষ মরতে দেখেছি, দুই বিমানবালা আমার কাছেই ছিলো। কিছুক্ষণের জন্য, মনে হয়েছিল আমিও মারা যাব, কিন্তু যখন আমি চোখ খুলে তাকালাম, তখন বুঝতে পারলাম বেঁচে আছি।
রমেশের চিকিৎসা করা ডাঃ ধবল গামেতি বলেন, তিনি বিচলিত, তার সারা শরীরে একাধিক আঘাত রয়েছে, তবে তিনি বিপদমুক্ত বলে মনে হচ্ছে। শুক্রবার সকালে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন এবং রমেশসহ আহত ও নিহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে হাসপাতালে যান।
ডাউনিং স্ট্রিটের একজন মুখপাত্র বলেন, পররাষ্ট্র দপ্তর শুক্রবার সকালে রমেশের সঙ্গে কনস্যুলার সহায়তা দেয়ার জন্য যোগাযোগ করেছে। রমেশের ভাই অজয়ও বিমানে ছিলেন। তাদের চাচাতো ভাই হীরেন কান্তিলাল বলেন যে, তারা ছুটিতে কয়েক মাস ধরে ভারতে ছিলেন।
তিনি বলেন, পরিবার শুক্রবার সকালে রমেশের সাথে কথা বলেছে, তিনি তাদের সাথে সঠিকভাবে হাঁটতে এবং কথা বলতে সক্ষম হয়েছেন। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারত থেকে বেরিয়ে যেদে চাই এবং যত দ্রুত সম্ভব বিশ্বাস কুমার রমেশের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
যুক্তরাজ্য এবং ভারতে বসবাসরত ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য, অথবা যাদের বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের জন্য উদ্বেগ রয়েছে, তাদের জন্য পররাষ্ট্র দপ্তর হেল্পলাইন স্থাপন করেছে। রমেশ পেশায় ব্যবসায়ী। ভারতে জন্ম নিলেও ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন, তার স্ত্রী এবং চার বছরের ছেলে রয়েছে।
ভারতে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন রমেশ। বৃহস্পতিবার দাদা অজয়কে নিয়ে লন্ডনে ফিরছিলেন। তখনই দুর্ঘটনা ঘটে। বিশ্বাস প্রাণে বাঁচলেও মারা যান অজয়। রমেশ জানিয়েছেন, উড়োজাহাজের অন্যদিকের আসনে বিমানের অন্যদিকের আসনে জায়গা পেয়েছিলেন তাই ভাই।
দুর্ঘটনার পর রমেশের বর্তমান ঠিকানা অহমেদাবাদের আসারওয়া সিভিল হাসপাতাল। তার বুকে, চোখে এবং পায়ে আঘাত লেগেছে। সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বলেছেন, যাত্রার ৩০ সেকেন্ড পরেই একটা বিকট শব্দ হয়। তার পরই উড়োজাহাজটি ভেঙে যায়। সব কিছু খুব ঘটে।
বিশ্বাস আরও বর্ণনা করেন, ‘আমি যখন উঠি, তখন আমার চারপাশে মৃতদেহের স্তূপ। আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি উঠে দৌঁড়াতে শুরু করি। আমার চারপাশে বিমানের টুকরো পড়ে ছিল। এর পর আমায় উদ্ধার করে অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুক্রবার সকালে রমেশ আহমেদাবাদ সিভিল হাসপাতালের ডাক্তারদের জানান, তার আসনটি খুলে বেরিয়ে এসেছিল। সেই কারণে হয়তো তিনি বাঁচতে পেরেছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশ্বাস বলেন, গোটা বিমান ভেঙে পড়ল। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনিতে আমার সিটটা খুলে এসেছিল। তাই হয়তো আমি বেঁচে গেলাম।
তিনি বলেন, ‘আমি যে দিকে পড়েছিলাম, সেখানে হোস্টেলের একতলার ফাঁকা জায়গা ছিল কিছুটা। সেখান দিয়ে আমি বেরিয়ে আসার চেষ্টা করি। কিন্তু উল্টো দিকে হোস্টেলের দেয়াল ছিল। সেদিক থেকে হয়তো কেউ বেরোতে পারেননি। আমার বাঁ হাত একটু পুড়ে গিয়েছে।
অহমদাবাদ সিভিল হাসপাতালের অধ্যাপক এবং শল্যচিকিৎসা বিভাগের প্রধান রজনীশ পটেল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিশ্বাসের অবস্থা খুব গুরুতর নয় এবং আগামী কয়েক দিনের মধ্যে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।