পরীমনির পেছনে রয়েছে শামসুন্নাহার স্মৃতির গল্প। ১৯৯২ সালের অক্টোবরে নড়াইলে জন্ম নেওয়া স্মৃতি খুব ছোটবেলায় মাকে হারান, একটু বড় হয়ে বাবাকে হারিয়ে বড় হন পিরোজপুরে নানা শামসুল হক গাজীর কাছে। সেখান থেকেই মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক শেষে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে বাংলা বিভাগে বিএ পড়াকালীন ২০১১ সালে ঢাকায় চলে আসেন এবং বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শেখেন। পরে শুরু করেন মডেলিং। এরপর ছোট পর্দায় আবির্ভাব হয় তার, সঙ্গে চলে টিভি নাটকে অভিনয়। শামসুন্নাহার নাম বদলে হয়ে ওঠেন পরীমনি।
অভিনয় জীবন শুরুতে তিনি সেকেন্ড ইনিংস, এক্সক্লুসিভ, এক্সট্রা ব্যাচেলর, নারী ও নবনীতা তোমার জন্য এ চারটি ধারাবাহিক নাটকে কাজ করেছেন। এর মধ্যে জাকারিয়া শৌখিন রচিত 'নারী ও নবনীতা তোমার জন্য' নাটকে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন পরীমনি। এতে চিত্রনায়ক আমিন খান, চিত্রনায়িকা পপি এবং ঈশানাও অভিনয় করেছিলেন। প্রথম অভিনীত নাটকেই তিনি ইলিয়াস কাঞ্চন এবং চম্পার সাথে অভিনয় করেন।
মুক্তির আগেই ২৩টি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন পরীমনি। ছবি মুক্তির আগেই মিডিয়ায় নানা ধরনের খবরের জন্ম দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন তিনি। শাহ আলম মন্ডল পরিচালিত ভালোবাসা সীমাহীন তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র।
পরী আলোচনায় আসেন নজরুল ইসলাম খানের রানা প্লাজা চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর থেকে। পরবর্তীতে ওয়াজেদ আলী সুমন পরিচালিত পাগলা দিওয়ানা ও দরদিয়া, এস এ হক অলীকের আরো ভালোবাসবো তোমায় চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০১৬ সালে মুক্তি পায় তার মন জানে না মনের ঠিকানা, পুড়ে যায় মন, ওয়াজেদ আলী সুমনের অ্যাকশনধর্মী রক্ত, এবং শফিক হাসানের ধূমকেতু। ২০১৭ সালে মুক্তি পায় কত স্বপ্ন কত আশা, আপন মানুষ, সোনা বন্ধু, এবং মালেক আফসারীর অন্তর জ্বালা।
জানা যায়, রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় থাকায় এতদিন পরীমণিকে নিয়ে কেউ তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। তার অতীত ও বর্তমানের নানা কাহিনী জানা থাকলেও কেউ মুখ খোলেনি। তবে তাদের সবার এক কথা, পরীমণি যতটা না নায়িকা হতে পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি প্রভাবশালী মহলে বিচরণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
২০০৭-০৮ সালের দিকে পরীমনির মা আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মারা যান। তার মায়ের মৃত্যুর বিষয়টি অনেকটা রহস্যাবৃত। এরপর থেকে পরীমণিকে তার বাবা সঙ্গে রাখতেন। ২০১২ সালের ২১ জানুয়ারি সিলেটে পরীমনির বাবাকে খুন করা হয় বলে পরীমনির ঘনিষ্ট সূত্রে জানা যায়।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে পরীমনির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠা এবং সেগুলো ভেঙে যাওয়ার খবর বের হয়। সিনেমার চেয়েও অন্যজগতেই যেন বেশি আলোচনার ঝড় তুললেন এই রুপালি ঢাকাই সিনেমার নায়িকা।
পরিমনির প্রথম বিয়ে হয় ২০১১ সালে তার খালাতো ভাই ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। প্রথম বিচ্ছেদের পর পরীমনি ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার বাসিন্দা ফেরদৌস কবীরের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর সাংবাদিক তামিম হাসানের সাথে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পরীমনির বাগদান সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে তাদের এনগেজমেন্ট ভেঙে যায়।
এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ তিনি পরিচালক কামরুজ্জামান রনিকে তিন টাকা দেনমোহরে বিয়ে করেন। ঐ বছরেই তাদের বিচ্ছেদ হয়।
গভীর রাতে বোট ক্লাবের ঘটনা পরীমনিকে আবার সামনে নিয়ে আসে। এরপর থেকেই একে একে বের হয়ে আসছে তার জীবনের নানা কাহিনী। কে এই পরীমনি এবং কিভাবে শো বিজে তার আগমণ ও অল্প সময়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন? এসব প্রশ্ন এখন চলচ্চিত্রাঙ্গণের লোকজনের মধ্যে আলোচিত হচ্ছে।
প্রথম থেকেই নানান বিতর্কের জন্ম দিয়ে চলছিলেন পরী। কোনো নতুন নায়িকার পক্ষে একসঙ্গে বিশ-পঁচিশটি সিনেমায় চুক্তিবদ্ধ হওয়া নিয়ে তখন চলচ্চিত্রাঙ্গণে বেশ তোলপাড় শুরু হয়। যদিও উপরে ওসব চলচ্চিত্রের অর্ধেকই নির্মিত কিংবা মুক্তি পায়নি। এ পর্যন্ত পরীমনি অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাগুলোও ব্যবসা সফল হয়নি। তারপরও পরীমনি ব্যাপক প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে।
চলচ্চিত্রের এক সময়ের বড় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া কর্ণধার তাকে দামী গাড়ি উপহার দেন বলে জানা যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত তার প্রতিষ্ঠান থেকে পরীমনিকে নিয়ে সিনেমা নির্মিত হয়নি। চলচ্চিত্রে অভিনয় করাকালেই তার সাথে ক্ষমতাসীন দলের এক শীর্ষ স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ হয়। বছর কয়েক আগে ঢাকার বাইরে একটি সিনেমার শুটিং চলাকালে পরীমনিকে শুটিং স্পট থেকে হেলিকপ্টারে করে তার এলাকায় নিয়ে যান তিনি। এ নিয়ে তখন চলচ্চিত্র পাড়ায় বেশ গুঞ্জণ ছড়ায়।
আরও পড়ুন: গোয়েন্দা কর্মকর্তার বাসায় ১৮ ঘণ্টা কাটিয়েছেন পরীমনি
এছাড়া বরিশালে আরেকটি সিনেমার শুটিং চলাকালে সেখানে পরীমনির নিরাপত্তার জন্য উক্ত জনপ্রতিনিধির অনুসারীরা দায়িত্ব পালন করেছিল। পরবর্তীতে নানা ঘটনার পরম্পরায় উক্ত জনপ্রতিনিধির সাথে পরীমনির দূরত্ব বৃদ্ধি পায়। ইতোমধ্যে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন শিল্পপতিদের সাথে তার সখ্য গড়ে উঠে।
মাস দুয়েক আগে পরীমনি দুবাই বেড়াতে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সে সময় তার সঙ্গে এক শিল্পপতি ছিলেন। পরীমনি বেশ জাঁকজমকের সাথে তার গত জন্মদিনের আয়োজন করেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে।
এসব ঘটনায় চলচ্চিত্রাঙ্গণে প্রশ্ন উঠে, পরীমনির এই শান-শওকতে চলার অর্থ কোথা থেকে পান। যার কোনো সিনেমা হিট হয়নি, হাতেও তেমন কাজ নেই-এ অবস্থায় অল্প সময়ে এত টাকার মালিক হলেন কিভাবে?
যেখানে অনেক নামকরা ও সুপারহিট সিনেমা উপহার দেয়া চিত্রনায়িকা যুগের পর যুগ অভিনয় করেও এত অর্থবিত্তের মালিক হতে পারেননি, সেখানে পরীমনির মতো নায়িকা যার উল্লেখ করার মতো চলচ্চিত্র ক্যারিয়ার নেই, মাত্র অল্প কয়েক বছরে অর্থবিত্তের মালিক হওয়া অস্বাভাবিক ঘটনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চলচ্চিত্রাঙ্গণের বেশ কয়েকজন শিল্পী বলেন, শোবিজে পরীমনি তার অভিনয় দিয়ে যতটা না পরিচিতি পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন ক্ষমতাশালী ও প্রভাবশালী মহলে তার ঘনিষ্ট চলাফেরা দিয়ে।
সম্প্রতি র্যাবের অভিযানে আটক হবার পর ডিবি জানায়, পরীমনি সিনেমার আড়ালে অবৈধ ব্যবসা করতেন।
বুধবার (৪ আগস্ট) বনানীর বাসা থেকে ভয়াবহ সব মাদকসহ (মদ, এলএসডি, সীসা) আটক করা হয় পরীমনিকে। একই দিনে আটক হন পরীমনির বন্ধু পরিচালক রাজ। আটকের পরীমনিকে বৃহস্পতিবার (৫ আগস্ট) আদালতে তোলা হয়। এসময় আবেদনের প্রেক্ষিতে পরীমনি, রাজ ও আটক আরও দুইজনকে পৃথকভাবে চার দিন করে রিমান্ড রিমান্ড প্রদান করে আদালত। পরবর্তীতে পরীমনি ও তার সহযোহীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলাগুলো ডিবিতে প্রেরণ করা হয়।
এই ডামাডোলের ভেতরেই একাত্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে পরীমনির সাথে এক ডিবি কর্মকর্তার মেলামেশার খবর। প্রকাশ হয় একটি সিসিটিভি ফুটেজও।
শনিবার (৭ আগস্ট) মামলা তদন্তের খাতিরে চলচ্চিত্র অভিনেত্রী পরীমনির সঙ্গে ডিবি কর্মকর্তা গোলাম সাকলায়েনের অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগে তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা গুলশান বিভাগ থেকে ডিএমপির পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) পশ্চিমে বদলি করা হয়।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পরীমনির মামলাটি সিআইডিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। তদন্তের পর নিশ্চয়ই আমাদের সামনে হাজির হবে আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্য!
একাত্তর/এআর