পাঁচ দশকেরও বেশি সময়ের সাহিত্যিক ক্যারিয়ারে হত্যার হুমকি পাওয়া সালমান রুশদির জন্য নতুন কোনো বিষয় নয়। সর্বকালের অন্যতম জনপ্রিয় ও সফল এই ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক তার মিডনাইটস চিলড্রেন বইয়ের জন্য ১৯৮১ সালে বুকার প্রাইজ জেতেন।
তবে তার সবচেয়ে বিতর্কিত বই হয়ে দাঁড়ায় ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত স্যাটানিক ভার্সেস। বইটিতে তাদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ব্যাপক প্রতিবাদ জানান মুসলিমরা।
এই বইকে কেন্দ্র করে রুশদিকে একাধিকবার হত্যার হুমকি দেয়া হয়, যার ফলে আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন তিনি। তাকে পুলিশি নিরাপত্তা দেয় ব্রিটিশ সরকার।
স্যাটানিক ভার্সেসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ফতোয়া জারি করেন ইরানের ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খোমেনি। বইটি প্রকাশ হওয়ার পরের বছর রুশদির মাথার মূল্য তিন মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করে তাকে হত্যার আহবান জানান খোমেনি।
বইটির প্রতি এই সহিংস প্রতিক্রিয়া মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর যে হুমকি দেয় তার নিন্দা করেন পশ্চিমা বিশ্বের লেখক ও বুদ্ধিজীবী সমাজ।
ভারতের স্বাধীনতা লাভের মাত্র দুই মাস আগে তৎকালীন বম্বেতে জন্মগ্রহণ করেন সালমান রুশদি। শিক্ষা লাভের জন্য ১৪ বছর বয়সে তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কেমব্রিজের কিংস কলেজ থেকে ইতিহাসে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন তিনি।
এক পর্যায়ে ব্রিটিশ নাগরিকত্ব লাভ করা রুশদি ধীরে ধীরে তার মুসলিম ধর্মবিশ্বাস থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। অল্প সময়ের জন্য অভিনেতা ও বিজ্ঞাপন কপিরাইটার হিসেবে কাজ করতে করতে উপন্যাস লেখা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি।
তার প্রথম প্রকাশিত বই গ্রিমাস খুব একটা সাফল্যের মুখ না দেখলেও, সমালোচকরা তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা দেখতে পান।
দ্বিতীয় বই মিডনাইটস চিলড্রেন লিখতে রুশদি সময় নেন পাঁচ বছর। বুকার প্রাইজ জেতা বইটি তাকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয়।
তবে ১৯৮৮ সালে সারিয়ালিস্ট ও পোস্টমডার্ন ধাঁচের স্যাটানিক ভার্সের প্রকাশ হওয়ার পর তা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদের জন্ম দেয়। একে 'ব্লাসফেমাস' বলে আখ্যা দেন বহু মুসলিম।
প্রথমে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ভারতে। এরপর একে একে পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
বইটি প্রশংসাও পায় প্রচুর। হুইটব্রেড প্রাইজ ফর নভেলস পুরস্কারও যেতে বইটি। তবে একে নিয়ে নিন্দা বাড়তে বাড়তে দুই মাসের মাথায় আন্দোলন ঘনীভূত হয়।
১৯৮৯ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ডে বইটির একটি কপি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানান মুসলিমরা। এই সময় বইটি নিয়ে মুম্বাইতে তীব্র দাঙ্গায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। তবে এতকিছুর পরও ব্লাসফেমির অভিযোগ অস্বীকার করে যান রুশদি।
যুক্তরাজ্যে কিছু কিছু মুসলিম নেতা মুসলমানদের ধৈর্য ধরার আহবান জানালেও, অনেকে আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে সমর্থন করেন।
এরই মধ্যে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে আত্মগোপনে চলে যান রুশদি। মুসলিমদের কষ্ট দেয়ার জন্য অনুশোচনা প্রকাশ করলেও, আয়াতুল্লাহ আবারও তাকে হত্যার আহবান জানান।
তবে সবকিছু উপেক্ষা করে আটলান্টিকের দুই পারেই বেস্ট সেলার লিস্টে জায়গা করে নেয় স্যাটানিক ভার্সেস। মুসলমানদের এই তীব্র প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সমর্থন জানায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। তেহরান থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের সাময়িকভাবে ফিরিয়ে আনা হয়।
তবে এই বইয়ের জন্য শুধুমাত্র সালমান রুশদিকেই হত্যার হুমকি দেয়া হয়নি। ১৯৯১ সালে বইটির জাপানি অনুবাদককে টোকিওতে গলাকেটে হত্যা করা হয়। তার খুনিকে এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
স্যাটানিক ভার্সেসের ইতালীয় ও নরয়েজিও অনুবাদককেও হত্যার চেষ্টা করা হয়, তবে ভাগ্যক্রমে তারা বেঁচে যান।
পরবর্তী সময়ে রুশদি মূলত শিশুদের জন্য বই লিখেছেন। ২০০৭ সালে তাকে নাইট উপাধি দেন ব্রিটেনের রানি।
১৯৯৮ সালে তার মৃত্যুদণ্ডের আহবানকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন দেয়া বন্ধ করে দেয় ইরান সরকার। তারপর থেকে তুলনামূলকভাবে একটি স্বাধীন জীবন যাপন করছেন তিনি।
তবে তার জীবনের প্রতি হুমকি এখনও পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দেয়। এ সম্পর্কে ইরানের বর্তমান নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একবার বলেছিলেন, 'রুশদির বিরুদ্ধের ফতোয়া ছিল একটি নিক্ষিপ্ত বুলেট, যা তার লক্ষ্য ভেদ করার আগ পর্যন্ত থামবে না।'
একাত্তর/এসজে