পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের প্রতিষ্ঠাতা ইমরান খানের ডাকা বিক্ষোভ সমাবেশকে ঘিরে উত্তাল দেশটি। ইমরানের মুক্তি ও সরকারের পদত্যাগের দাবিতে পিটিআইয়ের ডাকা বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদ। সব বাধা উপেক্ষা করে সোমবার ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে পিটিআই নেতা-কর্মীদের গাড়িবহর।
এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে দফায় দফায় পিটিআই সমর্থকদের সংঘর্ষ হয়। ইসলামাবাদমুখী জনস্রোতে এক পর্যায়ে সহিংস রূপধারণ করে। পিটিআই নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে দেশটিতে ছয়জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে চারজনই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে জানা গেছে। বিক্ষোভ ঠেকাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে পিটিআইয়ের পাঁচ পার্লামেন্ট সদস্যসহ প্রায় চার হাজার জনকে।
পাকিস্তানের সংবাদ ও গণমাধ্যম জানিয়েছে, নিহতদের মধ্যে চারজন আধাসামরিক বাহিনী রেঞ্জার্সের সদস্য এবং অন্য দুজন পুলিশ কর্মকর্তা। এছাড়া উত্তাল পাকিস্তানে আহত হয়েছেন আরও শতাধিক পুলিশ সদস্য। বিক্ষোভ ও মিছিলে কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদ। এমন অবস্থায় রাজধানী ইসলামাবাদে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে দেশটির শাহবাজ সরকার।
পিটিআই নেতা-কর্মীদের ঠেকাতে ইসলামাবাদের সব প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের সভা-সমাবেশ ও জমায়েত। কার্গো কনটেইনার দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে ডি–চকের প্রবেশপথ। উত্তাল ইসলামাবাদে সংবিধানের ২৪৫ ধারা সক্রিয় করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হলেও পিটিআই সমর্থকদের বিক্ষোভ সমাবেশকে দমানো যায়নি। এড়ানো যায়নি সহিংসতা।
পাকিস্তানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে সেনা বাহিনীকে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এবং দুর্বৃত্তদের কঠোরভাবে মোকাবিলা করার অনুমতি দিয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে কারফিউ জারি করার ক্ষমতাও দিয়েছে সেনাকে। এছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীকে ইমরানের সমর্থকদের দেখা মাত্রই গুলি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও বেশ কয়েকটি সূত্র জিও নিউজকে ইঙ্গিত দিয়েছে।
জিও নিউজ বলছে, শ্রীনগর হাইওয়েতে মর্মান্তিক ঘটনার পরে সেনা মোতায়েন ও ‘দুর্বৃত্তদের’ গুলি করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। সেখানে পিটিআই কর্মীরা রেঞ্জার্স সদস্যদের ওপর একটি গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে বলে জানা গেছে। যার ফলে দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ চারজন রেঞ্জার্স সদস্য নিহত হয়েছে এবং আরও পাঁচজন আহত হয়েছেন। এছাড়া শতাধিক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নকভি পিটিআইয়ের নেতাকর্মীদেরকে রাজধানীর প্রবেশমুখ ডি-চকে তাদের মিছিল থামাতে বলেছেন। অন্যথায় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। মঙ্গলবার পিন্ডিতে ডি-চক পরিদর্শন ও নিহত পুলিশ সদস্যের জানাজা শেষে মন্ত্রী জানান, সরকার পিটিআইকে রাজধানীর স্পর্শকাতর স্থানে প্রবেশের পরিবর্তে সাংজানিতে তাদের অবস্থান কর্মসূচির বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে।
তিনি বলেন, পিটিআইকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা সাংজানিতে যাবে কিনা। তারা এখানে (ডি-চকে) পৌঁছাতে চেয়েছে এবং আমরা তাদেরকে সে সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু এটি এখন আর চলতে পারে না। আমরা যেখানে প্রয়োজন সেখানে নম্রতা দেখিয়েছি কিন্তু একবার রেড লাইন অতিক্রম করলে সরকার চরম পদক্ষেপ নেবে।
বিক্ষোভকারীরা তাদের বিক্ষোভকে উৎসাহিত করার জন্য একটি লাশ পাওয়ার চেষ্টা করছিল। তবে সরকার নিশ্চিত করেছে, এমন কোনও পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
তবে পিটিআই নেতা ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আলি আমিন গান্ডাপুর কর্মীদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বলেছেন, আমরা পিছু হটব না এবং ইসলামাবাদ পৌঁছানো পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। অর্থাৎ সরকার এবং পিটিআই উভয়ই তাদের অবস্থান ধরে রেখেছে। এর ফলে দেশটিতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত অবস্থায় রয়েছে এবং সংঘাতের মাত্রা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতা ইমরানের স্ত্রী বুশরা বিবি ইসলামাবাদের ডি-চক এলাকায় বিক্ষোভ করার অবস্থানে অনড় রয়েছেন। তাই ডি–চকের পরিবর্তে সাংজানি এলাকায় বিক্ষোভ করার চেষ্টা বুশরা বিবির এই অনড় অবস্থানের কারণে কার্যত ভেস্তে গেছে। বিক্ষোভস্থল বদলাতে বুশরার সঙ্গে বারবার বৈঠক করেছেন পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা আলী আমিন গান্দাপুর ও ওমর আইয়ুব।
ইসলামাবাদ অভিমুখী জনস্রোতে অংশ নিয়েছেন বুশরা নিজেও। বুশরার গাড়িতে গিয়ে দেখা করে বিক্ষোভ স্থল বদলে ফেলতে তাকে রাজি করানোর চেষ্টা করেছিলেন গান্দাপুর ও আইয়ুব। কিন্তু বুশরা রাজি হননি। অনড় বুশরা জানিয়ে দিয়েছেন, সরকারের বাধা সত্ত্বেও পূর্বঘোষণা অনুযায়ী তিনি ইসলামাবাদের সুরক্ষিত ডি–চক এলাকাতেই বিক্ষোভ করতে চান। ফলে পরিস্থিতি এখন জটিল আকার ধারণ করেছে।
সম্প্রতি কারাবন্দি অবস্থাতেই ইসলামাবাদসহ দেশের বড় সব শহরে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছিলেন পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফের (পিটিআই) নেতা তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান। গত এক বছর ধরে কারাবন্দি রয়েছেন ইমরান। তার বিরুদ্ধে ১৫০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। নওয়াজ শরিফের সরকার এই সংঘর্ষের জন্য ইমরানকেই দায়ী করেছে। যদিও জামিন পেয়েও ইমরান খানও এখনও কারাবন্দি।
নতুন করে এই সংঘর্ষের ফলে নতুন করে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে শরিফ সরকার। বেশ কিছুদিন ধরে তারা আন্তর্জাতিক তহবিল (আইএমএফ) থেকে আর্থিক অনুদান নিয়ে দেশের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। অর্থমন্ত্রী মুহম্মদ আওরঙ্গজেব জানিয়েছেন, এই অশান্তির ফলে দেশের অর্থনীতির দৈনিক ১৪ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।