ইসরাইলি এক নারী আইনজীবী ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন- হামাসের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত গণধর্ষণের অভিযোগে এনে গোটা বিশ্বেই হইচই ফেলে দিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক আইন, মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করা এই নারী আইনজীবী সেই জন্য বড় ধরনের রাষ্ট্রীয় সম্মাননাও দিয়েছিলো ইসরাইল।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। মিথ্যা যে কখনও স্থায়ী হয় না, আর সত্যকে লুকিয়ে রাখা যায় না, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। এখন সেই ইসরাইলি নারী আইনজীবীর বিরুদ্ধে বড় ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারি এবং হামাসের ব্যাপারে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ তুলেছে সেই দেশেরই গণমাধ্যমগুলো।
ইসরাইলি এই আইনজীবী কোচাভ এলকায়াম লেভি তথাকথিত একটি ‘সিভিল কমিশনের’ প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে গত ৭ অক্টোবর নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে হামাসের যৌন অপরাধ শীর্ষক একটি বানোয়াট খবর ছড়িয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা মিডিয়া ও সংবাদ সংস্থাগুলো তার উদ্ধৃতি দিয়ে এই মিথ্যা খবর বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়।
কোনো প্রমাণ ছাড়াই প্রচার চালাতে থাকে যে, ফিলিস্তিনের সংগ্রামী যোদ্ধারা ইসরাইলি সেনাদের বিরুদ্ধে হামলা চালানোর সময় পরিকল্পিতভাবে যৌন অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যদিও হামাস দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এমন ধরনের অভিযান অস্বীকার করে আসছে। বলছে, তাদের অভিযানে কোন নারী-শিশু আক্রান্ত হয়নি।
ইসরাইলের প্রভাবশালী দৈনিক হারেৎজ এক নিবন্ধে বলেছে, কোচাভ এলকায়াম লেভি ফিলিস্তিনের সশস্ত্র সংগঠন হামাসের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তকর খবর প্রচার করেছে। এছাড়া, ওয়াই নেট নামে ইসরাইলের আরেকটি সংবাদমাধ্যমও একই কথা জানিয়ে বলেছে, মানুষজন এখন এলকায়াম থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।
লেভি এমনকি সিএনএন চ্যানেলের একজন মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ হিসাবে উপস্থিত হয়ে হামাসের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগতভাবে ধর্ষণ ও নির্যাতন কর্মকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বক্তব্য দেন। সেই সময়ে তিনি দাবি করেন, তার কোন সন্দেহ নেই আল-আকসা ফ্লাডের সময়ে হামাস যৌন নির্যাতনও চালিয়েছে।
এরপর গত বছর ৬ ডিসেম্বর হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ এবং জেন্ডার পলিসি কাউন্সিলের পরিচালক জেনিফার ক্লেইন হামাসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও রিপোর্ট তৈরির জন্য ইসরাইলি আইনজীবী কোচাভ এলকায়াম লেভিকে ওয়াশিংটনে আমন্ত্রণ জানান।
লেভির রিপোর্টের কারণে তাকে ইসরাইল সরকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার প্রদান করে। তার এই পুরস্কার গ্রহণ ও বক্তব্যের ঠিক তিনদিন পর ইসরাইলের বৃহত্তম সংবাদপত্র দৈনিক ওয়াই নেট তিক্ত সত্য ঘটনা ফাঁস করে দেয়। দৈনিকটি এক প্রতিবেদনে উল্টো লেভিকে প্রতারক হিসাবে আখ্যায়িত করেছে।
মূল ঘটনা হচ্ছে, বাইডেন প্রশাসনের একজন সদস্যসহ এলকায়াম লেভির আর্থিক পৃষ্ঠপোষকরা ৭ অক্টোবর হামাসের বিরুদ্ধে যৌন সহিংসতার মিথ্যা গল্প বানিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য বলেছিল। ইসরাইলি একজন কর্মকর্তা ওয়াই নেটকে বলেন, লেভির সব গবেষণা প্রতিবেদন ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
ইসরাইলের আরেকটি গণমাধ্যম ইয়েদিওথ আহরোনোথ টোয়েন্টি ফোর এক প্রতিবেদনে বলেছে, এলকায়াম ভুল গবেষণাপত্র তৈরি করেছেন এবং হামাসের নৃশংসতা সম্পর্কে মিথ্যা গল্প ছড়িয়েছেন। একটি তথাকথিত ‘সিভিক কমিশন’-এর জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অনুদান একাই সংগ্রহ করেছেন।
ডোবারা ইনস্টিটিউটের প্রধান এবং হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক লেভি প্রথম মিথ্যা দাবি ছড়িয়ে বলেন, আল-আকসা অপারেশনের সময় হামাস পদ্ধতিগত ধর্ষণ করেছিল। এর পাশাপাশি হামাসের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতার বানোয়াট গল্প বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়েছেন এই নারী আইনজীবী।
একজন ইসরাইলি কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়াই নেট লিখেছে, লেভি তার সিভিল কমিশন গঠনে ব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়ের জন্য জন্য ৮০ লাখ ডলার চেয়েছিলেন এবং জাপানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাহাম ইমানুয়েল তাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন। এভাবে লেভি অনেকের কাছে টাকা চেয়েছিল।
যাহোক, পাঁচ মাসেরও বেশি তদন্তের পর, উচ্চমানের ও খ্যাতনামা হিসাবে পরিচিত এই আইনজীবী বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহের বৈধতা প্রমাণ করতে পারেনি। লেভি জাতিসংঘের যৌন সহিংসতা বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেনের ইসরাইল সফরে যাওয়ার পথে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
লেভির রিপোর্টকে হামাসের কথিত যৌন অপরাধের প্রমাণ হিসাবে প্রচার করে ইসরাইল। যদিও জাতিসংঘ জোর দিয়ে বলেছে, হামাসের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। লেভির মিথ্যাচারিতা আরো প্রমাণ হয়, যখন নিউইয়র্ক টাইমস বলে দেয়, হামাসের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই।
দ্য গ্রেজোন নামের আরেক ইসরাইল সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, এলকায়াম-লেভি সিরিয়ায় নিহত নারী কুর্দি যোদ্ধাদের ছবি উপস্থাপন করে দাবি করেন যে, তারা ইহুদি ইসরাযইলি নারী, যারা নোভা মিউজিক ফেস্টিভ্যালে হামাস যোদ্ধাদের দ্বারা নিহত ও ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।