বিকাল ৪টা ২০ মিনিট। চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল-১ (এনসিটি) এ ভিড়লো এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিককে বহন করা লাইটার জাহাজ।
এনসিটি জেটিতে আগে থেকে অপেক্ষায় ছিলেন নাবিকদের স্বজন, জাহাজের মালিক পক্ষসহ বন্দর কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা।
এরপর একে একে নাবিকরা জাহাজ থেকে নেমে আসেন। যাদের জন্য দুই মাস ধরে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন কেটেছে স্বজনদের।
জেটিতে নাবিকরা নামার পর স্বজনরা তাদের জড়িয়ে ধরেন। এ সময় কেউ কেউ কেঁদে ওঠেন। বন্দরের এনসিটি এলাকায় সৃষ্টি হয় আবেগঘন পরিবেশের। এক ধরনের নিস্তব্ধতা নেমে আসে কর্মচঞ্চল জেটিতে।
এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের চিফ অফিসার আতিকুল্লাহ খান অপেক্ষায় থাকা সন্তানদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন।
আতিকুল্লাহকে নিতে এসেছিল তার দুই মেয়ে ফাতেমা, উনাইজা এবং ছোট ভাই আতিক খান। সাংবাদিকদের আতিকুল্লাহ বলেন, একটা বীভৎস সময় পার করে আলোয় এসেছি। স্বজনদের কাছে পেয়ে, দেশের মাটিতে পা দিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে… প্রকাশ করা যাবে না।
সোমবার সন্ধ্যা ৬টায় কুতুবদিয়ায় নোঙর করে এমভি আবদুল্লাহ। সেখান থেকে লাইটার জাহাজ জাহান মনি-৩ নাবিকদের নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।
চট্টগ্রামে পৌঁছানোর পর নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকা স্বজনরাও নাবিকদের ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। ভয়াবহ অভিজ্ঞতা থেকে বেঁচে ফিরে স্বজনদের কাছে পেয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন নাবিকরা।
আতিকুল্লাহ খানের মেয়ে উনাইজা সাংবাদিকদের বলে, বাবাকে কাছে পেয়ে ভালো লাগছে। দীর্ঘদিনের অপেক্ষা ফুরালো।
আতিকুল্লাহ খানের ছোট ভাই আবদুর নূর খান আসিফ বলেন, আমার বড় ভাই আর আমরা যে কতটা খুশি, তা ভাষায় বোঝাতে পারবো না।
জাহাজের ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদের মা জ্যোৎস্না বেগমের কাছে দিনটি ঈদের আনন্দের চেয়ে বেশি। তিনি বলেন, ঈদের চেয়ে বেশি আনন্দ হচ্ছে। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর ছেলের জন্য দুশ্চিন্তায় ছিলাম। ৩৩ দিন যে কীভাবে কেটেছে, তা ব্যাখ্যা করতে পারবো না।
গত ১২ মার্চ ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূলে সশস্ত্র সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে আবদুল্লাহ; নাবিকরা হন জিম্মি। মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে সোমালিয়া উপকূলের ৬০০ নটিক্যাল মাইল দূরে অস্ত্রের মুখে জাহাজ ও ২৩ নাবিককে জিম্মি করে ফেলে জলদস্যুরা।
এরপর ৩৩ দিন কাটে নানা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও গুঞ্জনের মধ্যে। গত ১৪ এপ্রিল মুক্তিপণ দিয়ে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয় ২৩ নাবিকসহ জাহাজটি।
পরিবারের সদস্যদের ফোন করে তারা জানান, মুক্তিপণ না দিলে তাদের একে একে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেই থেকে পরিবারের সদস্যদের ফিরে পেতে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ আর অনিশ্চিত অপেক্ষার শুরু।
আন্তর্জাতিক বাহিনী, সরকার ও জাহাজের মালিকপক্ষের নানা চেষ্টায় এক মাস পর জিম্মি দশা থেকে জাহাজসহ মুক্ত হন নাবিকরা। তবে বাড়ি ফিরতে লেগে যায় আরও এক মাস। মুক্তির পর নাবিকরা জাহাজ নিয়ে যান আরব আমিরাতে। সেখানে পণ্য খালাস করে আবার মালামাল তুলে রওনা হন দেশের পথে।
জাহাজের নাবিক ও ক্রুরা হলেন, জাহাজের মাস্টার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ, চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান, সেকেন্ড অফিসার মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, থার্ড অফিসার এন মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম, ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসাইন, চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ এস এম সাইদুজ্জামান, সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. তৌফিকুল ইসলাম, থার্ড ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিন, ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার তানভীর আহমেদ, ইঞ্জিনি ক্যাডেট আইয়ুব খান, ইলেকট্রিসিয়ান ইব্রাহীম খলিল উল্লাহ, ক্রু মো. আনোয়ারুল হক, আসিফুর রহমান, সাজ্জাদ হোসেন, জয় মাহমুদ, নাজমুল হক, আইনুল হক, মো. শামসুদ্দিন, আলী হোসেন, মোশাররফ হোসেন শাকিল, শরিফুল ইসলাম, নুর উদ্দিন ও সালেহ আহমদ।