প্রকৃতিকে আপনি যতটুকু দিবেন প্রকৃতি আপনাকে তার দ্বিগুণ করে ফেরত দিবে। কাঁটা দিলে পাবেন দ্বিগুণ কাঁটা, ফুল দিলে পাবেন ফুল। এটা যে শুধু কথার কথা নয়। ইতিহাস ঘটলেই পাওয়া যাবে মোক্ষম প্রমাণ। চড়ুই মেরে একবার চীন যে কী ভয়ানক বিপদে পড়েছিলো সে নিয়ে বলা যাক।
সালটা ১৯৫৯ থেকে ১৯৬০। চীনের ক্ষমতায় তখন আধুনিক সমাজতান্ত্রিক চীনের জনক মাও সে তুং। ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’ নামে এক আন্দোলন শুরু করেন তিনি। মাও বলেন, ইঁদুর, মশা, মাছি আর চড়ুই পাখি হলো মানুষের শত্রু। এদের মেরে ফেলা হোক। ইঁদুর, মশা আর মাছি মারায় উপকারই হয়েছিল হয়তো।
কিন্তু চড়ুই পাখি কেন মারতে হবে? বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে মাও জানলেন, একটি চড়ুই বছরে চার থেকে পাঁচ কেজি শস্য খায়। হিসেবে করে দেখা গেলো, ১০ লাখ চড়ুই ৬০ হাজার মানুষের খাবার খেয়ে ফেলে। ব্যস, আর যায় কোথায়, মাও বললেন, চড়ুই পাখিও মারো।
যেই বলা সেই কাজ। সবাই লেগে গেলো এই চার শত্রু দমনে। মিলিটারি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবাই এই কাজে অংশ নিলো। কেনা হল এক লাখ চড়ুই নিধন অভিযানের নিশান যেনো মশা মারতে কামান দাগা। খুঁদে পাখি মারতে মেতে উঠলো গোটা দেশ।
যারা এই কাজে এগিয়ে এলো তাদের নাম হল ‘স্প্যারো আর্মি’। এমনকি চড়ুই মারায় উত্সাহ দিতে পুরস্কার ঘোষণা করলো রাষ্ট্র। একাধিক পদ্ধতিতে মারা হল পাখি। উন্মত্ত জনতা ড্রাম বাজিয়ে ধাওয়া করত পাখির ঝাঁকের পিছনে। শোনা যায়, উড়া শেষে ক্লান্ত পাখি মাটিতে পড়ে মারা যেত।
খুঁজে খুঁজে ভাঙা হল চড়ুইয়ের বাসা, নষ্ট করা হল ডিম। জাল দিয়ে ধরা হল ছোট ছোট পাখিগুলোকে। বাকি পাখি মারা হল বন্দুক দিয়ে। অচিরেই মাওয়ের ইচ্ছা মতো চড়ুইশূন্য হল চীন। কিন্তু, তাতে কি লাভ হল রাষ্ট্রের, ভালো হলো কি দেশের মানুষের? বাঁচল কি খেতের ফসল? ইতিহাস কি বলছে চলুন দেখি।
আসলে চড়ুই শস্যের কিছু অংশ খেত ঠিক, তেমনই ফসল ধ্বংসকারী পোকামাকড়ও খেতো পুঁচকে পাখির দল। ফলে খেতে দেখা গেল পোকার উৎপাত। নষ্ট হল সে বছরের সিংহভাগ ফসল। পঙ্গপালের আক্রমণে এর পরের বছরের ফসলও গেল নষ্ট হয়ে চীনে দেখা দিলো মহাদুর্ভিক্ষ।
ঘরে খাবার নেই, যতটুকু ফসল উৎপাদিত হয়েছে সেগুলো পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে কমিউনগুলোতে। যা বাকি থাকে, তাতে সকলের ক্ষুধা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে মরতে লাগলো মানুষ। শোনা যায় বাঁচার জন্য চীনের গ্রামাঞ্চলে সে সময়ে নরমাংস ভক্ষণের মতো ভয়ানক ঘটনাও নাকি ঘটেছে দেদারসে।
এ অবস্থায় সাহায্যে এগিয়ে এসেছিল রেড ক্রস কিন্তু অহংকারী মাও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সেই সাহায্যের আবেদনও। কত মানুষ যে চীনের এই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল, তা আজ সঠিক করে বলা সম্ভব না। এটা হয়তো ছোট সে চড়ুই পাখিগুলোর অভিশাপ।
ভয়েই কিনা বলা যায় না তবে চীন সরকার পরবর্তী দুই দশক কোনো আদমশুমারি করেনি। পরবর্তীতে ১৯৮২ সালে যখন আদমশুমারির ফলাফল প্রকাশ পেলে তখন হিসেব করে দেখা গেলো, অন্তত ৩ কোটি মানুষ ওই দুর্ভিক্ষে মারা গিয়েছিল।