ইলহা দা কুইমাদা গ্রান্ডে। লাতিন অঞ্চলের নৈসর্গিক এক দ্বীপের নাম। এর নামটি যেমন অদ্ভুত, তেমনি এই দ্বীপ নিয়ে রয়েছে অপার রহস্য। দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের মাঝে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে দ্বীপটি। ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে ইলহা দা কুইমাদা গ্রান্ডে দ্বীপের অবস্থান।
এই দ্বীপকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং মারাত্মক দ্বীপ বলা হয়। গোটা বিশ্বে এই দ্বীপটি পরিচিত স্নেক আইল্যান্ড বা স্বর্পদ্বীপ নামে। এ কারণেই এই দ্বীপে কেউ পা রাখার সাহস দেখান না। ব্রাজিল সরকার ওই দ্বীপে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এর পেছনে কারণ বিষাক্ত সব সাপের স্বর্গবাস।
গোটা ব্রাজিলের মানুষের মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে যে, ওই দ্বীপে গেলে জীবন্ত কেউ ফিরে আসে না! এ নিয়ে প্রচুর গল্পও প্রচলিত আছে। যেমন লাইটহাউস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সেখানে থাকা গোটা একটি পরিবারকেই মেরে ফেলছিলো সাপের দল। এমন গল্পের কথা জানা আছে ব্রাজিলবাসীর।
এই দ্বীপে কোথা থেকে এলো এতো সাপ? শোনা যায়, জলদস্যুরা লুট করা স্বর্ণ এই দ্বীপে লুকিয়ে রাখতো। কেউ যাতে সেগুলো হাতিয়ে নিতে না পারে সেজন্য কয়েকটি বিষাক্ত সাপ নিয়ে এসে দ্বীপে ছেড়ে দেয় তারা। সেই স্বর্ণের লোভে বারেবারেই সেখানে গেছে মানুষ। কিন্তু শোনা যায়, তারা কেউই ফেরেনি।
তারপর সেই সাপের বংশ বাড়তে থাকে। কয়েকটি সাপ থেকে হাজার হাজার সাপে ভরে যায় দ্বীপটি। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে ওই সাপ গোল্ডেন ল্যান্সহেড। বিশ্বের অন্যতম বিষধর সাপ এটি। সাপের সংখ্যা এতো বেড়েছে যে, প্রতি এক বর্গমিটারে একটা করে সাপ রয়েছে। এ কারণে এটিকে ‘স্নেক আইল্যান্ড’ বলা হয়।
কীভাবে দ্বীপটির উৎপত্তি? ইতিহাস বলছে, প্রায় ১১ হাজার বছর আগে সমুদ্র পৃষ্ঠের উত্থানে ব্রাজিলের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরে এটিকে এক দ্বীপে পরিণত করে। স্থানীয়ভাবে দ্বীপটি ‘ইলহাদা কুইমাদা গ্রান্দে’ নামে পরিচিত। প্রায় ২০ মাইল দীর্ঘ দ্বীপটিতে শুধু সাপেরই বসবাস।
গোল্ডেন ল্যান্সহেড ছাড়াও পৃথিবীর অন্যান্য বিষাক্ত সাপগুলো হাজার হাজার সংখ্যায় ওই দ্বীপের রয়েছে। তবে, পিট ভাইপার বা গোল্ডেন লাঞ্চহেড সাপের প্রধান আবাসস্থল এই দ্বীপ। অন্যান্য বিষধর সাপের থেকে এই সাপ কয়েকগুণ বেশি বিষধর হয়ে থাকে। এই প্রজাতির সাপ দেখতে উজ্জ্বল হলুদাভ বাদামি বর্ণের।
এগুলো গড়ে ২৮ ইঞ্চি থেকে সর্বোচ্চ ৪৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের বিষ এতটাই ভয়ানক যে, এই বিষ দিয়ে মুহূর্তেই মানুষের মাংসকে গলিয়ে ফেলা সম্ভব। সাধারণত এই সাপের বিষ মানুষের শরীরে প্রবেশ করার মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই মানুষটি মারা যায়।
প্রায় চার লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটারের এই দ্বীপটিতে কমপক্ষে চার লাখ ৩০ হাজার সাপ রয়েছে। হাজার হাজার পিট ভাইপার থাকা এই দ্বীপে স্থলচর প্রাণী একেবারে নেই বলা যায়। পরিযায়ী পাখি এবং সাগরের ওপরের থাকা পাখিগুলো এই দ্বীপে অবতরণ করলেই সাপগুলোর খাদ্য হয়ে যায়।
এসব সাপ আকাশে উড়ন্ত পাখিকেও ছো মেরে পেঁচিয়ে নিজের খাবারে পরিণত করে। এছাড়াও টিকটিকি এবং অন্যান্য সাপও আছে এদের খাদ্যে তালিকায়। বিরল প্রজাতির গোল্ডেন ল্যান্সহেড সর্বোচ্চ ২০ ইঞ্চি লম্বা হয়। মূল খাবার পাখি। এদের বিষ এতটাই মারাত্মক যে, এত মানুষের মাংস মুহূর্তের মধ্যে গলে যায়।
দ্বীপটিতে সরকারিভাবে কোনো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই। জাহাজের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই দ্বীপটিতে একটি লাইট হাউস তৈরি করা হয়েছিল ১৯০৯ সালে। এরপর থেকে অটোমেটিক সিগন্যাল ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে পর্যন্ত দু-একজনের বসবাস। তারপর থেকে একেবারে জনমানব শূন্য দ্বীপটি।
নৌবাহিনীর বিশেষ সদস্য লাইটহাউস পর্যন্ত গিয়ে ওপর থেকে নিরীক্ষণ করে যাতে কোনো ব্যক্তি অভিযানের জন্য দ্বীপে হাজির হতে না পারে। সাধারণ মানুষের ইলহা দা কুইমাদা গ্রান্ডেতে যাওয়ার অনুমতি নেই। যদিও জীববিজ্ঞানী ও গবেষকরা অনেক কষ্ট করে ব্রাজিল সরকার থেকে অনুমতি নিয়ে কখনো কখনো যান।