ইসলামিক অভ্যুত্থানের পর ইরানের শাসন ব্যবস্থায় ‘সুপ্রিম লিডার' সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৭৯ সালে আয়াতোল্লাহ রুহল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ওই অভ্যুত্থানের পর ১০ বছর দেশ শাসন করেন তিনি। তার মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে সুপ্রিম লিডার হন আয়াতুল্লাহ আলী খমেনি।
ইরানের ক্ষমতা কাঠামো কীসের ওপর নির্ভর করে, ক্ষমতার কেন্দ্রে কেই বা থাকেন, কলকাঠি নেড়ে থাকেন শাসন ব্যবস্থায়। একই সাথে ইরানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্র হওয়ার ইতিহাসটাও জেনে নেয়া দরকার। ইরানের ক্ষমতা কাঠামোয় রয়েছে পাঁচটি ধাপ। এসব ধাপ হলো- সুপ্রিম লিডার, প্রেসিডেন্ট, পার্লামেন্ট, অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্ট, কাউন্সিল অব গার্ডিয়ান্স।
সুপ্রিম লিডার: ইরানের সংবিধান অনুযায়ী ‘সুপ্রিম লিডার’ ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের সব অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতি নির্ধারণ করে থাকেন। তিনি দেশটির সেনাবাহিনীর প্রধান এবং যাবতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা তৎপরতার তত্ত্বাবধায়কও। এমনকি তিনি একাই যুদ্ধ বা শান্তি ঘোষণা করার ক্ষমতা রাখেন। বিচার বিভাগের নিয়োগ বা বহিষ্কার সম্পূর্ণরূপে তার হাতে। শাসন কাঠামোর পাঁচ নম্বরে থাকা কাউন্সিল অব গার্ডিয়ান্সও নিয়োগ দেন সর্বোচ্চ নেতা।
প্রেসিডেন্ট: প্রেসিডেন্ট ইরানে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর পদ। যদিও দেশটির সংবিধানে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় লাগাম টানা আছে। ইরানে প্রেসিডেন্ট মূলত দেশের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণ করেন। সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল নির্বাচনেও প্রেসিডেন্টের ভূমিকা থাকে। তার অধীনে আটজন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকেন। তার মন্ত্রিসভার সদস্য সংখ্যা ২২ জন।
পার্লামেন্ট: ইরানের এককক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ২৯০, যারা জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন। পার্লামেন্ট খসড়া আইন তৈরি করে, আন্তর্জাতিক নানা চুক্তির অনুমোদন দেয় এবং বাজেট নির্ধারণ করে থাকে। কাউন্সিল অব গার্ডিয়ান্স সবসময় পার্লামেন্টের উপর নজর রাখে। প্রভাবশালী এই পর্ষদ পার্লামেন্টে পাস হওয়া আইন শরিয়া আইনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা বা সাংঘর্ষিক কিনা তা যাচাই করে থাকেন।
অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্ট: জনগণের ভোটে নির্বাচিত ৮৬ জন ধর্মীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের সমন্বয়ে অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্ট গঠন করা হয়, এদের মেয়াদ আট বছর। তবে প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্ট নির্বাচনের মত এই নির্বাচনেও কাউন্সিল অব গার্ডিয়ান্স প্রার্থী ঠিক করে দেন। অ্যাসেম্বলি অব এক্সপার্ট বছরে একবার এক সপ্তাহের জন্য আলোচনায় বসেন। এই পর্ষদ থেকেই র্যাংক অনুযায়ী সুপ্রিম লিডার নির্বাচন করা হয় এবং বাকিরা তাকে পর্যায়ক্রমে সম্মতি দেন। সুপ্রিম লিডারের সাথে এই পর্ষদের মতপার্থক্য হওয়ার ঘটনা এখনো ঘটেনি।
কাউন্সিল অব গার্ডিয়ান্স: ১২ জন আইন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে কাউন্সিল অব গার্ডিয়ান্স গঠন করা হয়, যাদের মধ্যে ছয়জনকে নিয়োগ দেন সুপ্রিম লিডার। প্রধান বিচারপতি বাকি ছয়জনকে মনোনয়ন দেন এবং পার্লামেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে তাতে অনুমোদন দেয়। পার্লামেন্টে পাস হওয়া কোনো আইন তারা চাইলে পুনঃপর্যবেক্ষণের জন্য ফেরতও পাঠাতে পারেন। এমনকি প্রেসিডেন্ট প্রার্থীও তারা ঠিক করে দেন। এরপর পর্যায়ক্রমে আসে এক্সপিডিসি কাউন্সিল, জুডিশিয়ারি, ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনটেলিজেন্স।
এবার জেনে নেয়া যাক ইরানের বর্তমান সাংবিধানিক ব্যবস্থা। বিশ্বে চমক জাগানিয়া ইরানের ইসলামি বিপ্লব-পরবর্তী শাসনব্যবস্থা ও এর সাংবিধানিক ধারা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে অসম্ভব কৌতূহল। ইসলামি বিপ্লবের পর ১৯৮০ সালের ৩০ ও ৩১ মার্চ সব ধরনের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।
১৯৯০ সালে সংবিধানটি পুনরায় সংশোধিত আকারে বিন্যাস করা হয়। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হচ্ছেন সর্বোচ্চ নেতা-রাহবার সাইয়্যেদ আলী হোসেইনি খামেনি। দেশটির রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ও মাজহাব হচ্ছে বারো ইমাম জা'ফরি বা বারো ইমামি শিয়া। দেশটির সংবিধান ১৪টি অধ্যায় ও ১৭৭টি মূলনীতির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।
ইরানের প্রতিটি প্রদেশে অর্থাৎ ৩১টি প্রদেশে সর্বোচ্চ নেতার নির্দেশাবলি বাস্তবায়নে রয়েছেন একজন করে প্রতিনিধি, যিনি অবশ্যই একজন প্রখ্যাত দ্বিনি আলেম। প্রদেশের আয়তন ও জনসংখ্যা ভেদে একাধিক প্রতিনিধি হতে পারেন। সর্বোচ্চ নেতা সাধারণত জনগণের ভোটে নির্বাচিত আলেমদের 'বিশেষজ্ঞ পরিষদ' থেকেই প্রাদেশিক প্রতিনিধিদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। সর্বোচ্চ নেতার প্রাদেশিক প্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট প্রদেশে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও ভূমিকা পালন করেন। সর্বোচ্চ নেতার পরের ধাপে রয়েছে তিনটি শক্তিশালী বিভাগ। এগুলো হলো- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ তথা সংসদ, বিচার বিভাগ।
২৯০ জন এমপি নিয়ে গঠিত সংসদে ৪ বছর পরপর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংসদে জরথুস্ত্র ও কালিমিয়ান বা ইয়াহুদি অনুসারীদের থেকে ২ জন, অশুরি ও কালদানি খ্রিষ্ট সমাজ থেকে ১ জন এবং দক্ষিণ ও উত্তরের আর্মেনীয় খ্রিষ্টানদের থেকে ২ জন প্রতিনিধির সংসদে আসন সংরক্ষিত রয়েছে।
গ্বোভভে মুজরিয়ে বা নির্বাহী বিভাগের প্রধান হয়ে থাকেন ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট। মন্ত্রণালয়গুলো ও রাষ্ট্রদূত তাঁর অধীনে রয়েছেন। ৪ বছর মেয়াদি প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস আগে অবশ্যই নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। আর বিচারবিভাগ সব ধরনের বিচারিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এই তিনটি বিভাগ রাষ্ট্রকে ভারসাম্য দেয়ার পাশাপাশি সমান ক্ষমতার অধীকারি। তবে মূল ক্ষমতা রাহবার ও তার ১২ জন প্রতিনিধিই দেখেন।
এবার ফিরে দেখা যাক, ইরানের ইসলামিক বিপ্লবের ইতিহাস, আয়াতুল্লাহ রুহল্লাহ খমেনি ও আয়াতুল্লাহ আলী খমেনির সর্বোচ্চ নেতা হয়ে ওঠার কথা।
ইরানের ইসলামি বিপ্লাব: ৭০ এর দশকে শিয়া অধ্যুষিত ইরানে মোহাম্মাদ রেজা শাহ পাহলভির শাসন আমলে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে ইরানের জনগণ। সেই ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে ধর্মীয় নেতা ইমাম আয়াতুল্লাহ রুহল্লাহ খোমেনি ১৯৭৯ সালে অভ্যুত্থান ঘটান।
ক্ষোভের বীজ: ইরানের সেসময়কার শাসক মোহাম্মাদ রেজা শাহ পাহলভির একনায়কতন্ত্র এবং অত্যধিক মার্কিনপ্রীতিকে বিপ্লবের বীজ বপনের কারণ বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। ইরানের হাজার বছরের সংস্কৃতিতে পশ্চিমা, বিশেষ করে মার্কিন আগ্রাসনকে মেনে নিতে পারেনি দেশটির জনগণ। সে কারণেই খোমেনিকে সমর্থন করে হাজারও মানুষ।
রেজা শাহ পাহলভি: ইরানের শেষ সম্প্রাট রেজা শাহ পাহলভি। পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজতন্ত্রের বংশধর ছিলেন তিনি। তাঁর বংশ আড়াই হাজার বছরের পুরোনো পারস্য রাজতন্ত্রের ধারক ছিলেন। ১৯৫৩ সালে জনভোটে বিজয়ী প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে হটিয়ে ব্রিটিশ ও মার্কিন মদতে সর্বময় ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করেন পাহলভি। ৬৭ সালে আনুষ্ঠানিক ক্ষমতা গ্রহণ করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট: যুক্তরাষ্ট্রের পাপেট বা পুতুল বলে পরিচিত ছিলেন রেজা শাহ পাহলভি। তাঁর আমলে ইরানের সংস্কৃতিগত সংকটের পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকটও দেখা গেছে দারুণভাবে। বিশেষ করে তেল ব্যবসায় প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্রিটিশ ও মার্কিন কোম্পানিগুলোর। সংস্কৃতিগত অবক্ষয়ের কারণে ধর্মপ্রাণ ইরানি মুসলমানদের মধ্যে রাজতন্ত্রবিরোধী ক্ষোভ দানা বাধে।
আয়াতুল্লাহ রুহল্লাহ খোমেনির উত্থান: ৪৪ বছর আগে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্সে নির্বাসিত জীবন শেষে ইরানে ফিরে ইসলামি বিপ্লবের সূচনা করেন। তিনি ছিলেন দেশটির ধর্মীয় নেতা। ১৯৭৮ সালে খোমেনি ইরাকে শিয়াদের পবিত্র ধর্মীয় নগরী নাজাফে কড়া পাহারায় নির্বাসিত ছিলেন। পরে ইরাক থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। তখন তিনি ফ্রান্সে আশ্রয় নেন এবং পরে ইরানের বিপ্লবে ভূমিক রাখেন।
ইরানের ব্ল্যাক ফ্রাইডে: ১৯৭৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শুক্রবার, রাজধানী তেহরানে শাহবিরোধী এক বিশাল জনসমাবেশ হয়। সেদিন রেজা শাহের বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালিয়ে কয়েকশ' বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে। ওই সমাবেশে ৬০ থেকে ৭০ লাখ মানুষ জড়ো হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ইরানের বিপ্লবের পর সেই দিনটিকেই ব্ল্যাক ফ্রাইডে ঘোষণা করা হয়।
দেশ ছেড়ে পালান পাহলভি: ১৯৭৯ সালের ১৬ জানুয়ারি পালিয়ে যান পাহলভি। এর আগে জনবিক্ষোভের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে ৪ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী শাপর বখতিয়ারকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ঘোষণা করেন। এরপর পরিবারসহ পালিয়ে মিশরে আশ্রয় নেন শাহ পাহলভি। এর মধ্যদিয়ে শেষ হয় পাহলভি যুগের অধ্যায়।
দেশে ফিরলেন খোমেনি: ১৯৭৯ সালের জানুয়ারি মাসেই নির্বাসিত খোমেনিকে দেশে ফেরার অনুমতি দেয় ইরানের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান শাপর বখতিয়ার। ১৫ বছর নির্বাসনে কাটিয়ে ১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরেন খোমিন। সেসময় বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানায় লাখো মানুষ।
বিপ্লব দিবস: ১৯৭৯ সালের ১১ ফ্রেব্রুয়ারি ইমান খোমেনির নেতৃত্বে শাহের ক্ষমতাসীন প্রশাসনকে হটিয়ে দেয়া হয়। সেই সময় ইসলামি বিপ্লবের প্রধান নেতা হিসেবে প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন খোমেনি। এরপর থেকেই ১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের বিপ্লব দিবস পালন করা হয়।
ইসলামিক প্রজাতন্ত্র: ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের মাত্র দুই মাস পর ৩০ মার্চ দেশটিতে এক ঐতিহাসিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ওই গণভোটের মাধ্যমে ইরানের মানুষ ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে রায় দেন। সেসময় ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে ৯৮ দশমিক ২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এরপর ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়।
তবে মাত্র ১০ বছর দেশ শাসন শেষে খোমেনির মৃত্যুর পর ১৯৮৯ সালে সুপ্রিম লিডার হন আয়াতুল্লাহ আলী খমেনি। এরপর থেকে এখনো ইরানের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতি বহাল আছেন তিনি।