মা নাম রেখেছিলেন জন উইনস্টন লেনন। ব্রিটেনের জাতীয় নেতা উইনস্টন চার্চিলের থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই ছেলের এই নাম রেখেছিলেন মা জুলিয়া।
জুলিয়ার ছেলে উইনস্টন চার্চিলের মতো নেতা হননি তবে গিটারের ঝংকারে সমস্ত সঙ্গীত বিশ্বের প্রাণ হয়ে উঠেছিলেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন ‘ গিভ পিস আ চান্স’, ‘ইমাজিন’ বা ‘পাওয়ার টু দা পিপল’ এর মতো গান।
১৯৪০ সালের ৯ অক্টোবর ইংল্যান্ডের লিভারপুলে জন্ম জন লেননের। চারদিকজুড়ে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসতা। এই বীভৎসতার মাঝে জন্ম নেওয়া শিশুটিই ষাটের দশকের সংগীত জগতকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। যাকে আজও মনে রেখেছে পৃথিবীর সকল সঙ্গীত প্রিয় মানুষ। যার শুরুটাই হয়েছিলো নিউক্যাসল রোডের নোংরা, অপরিচ্ছন্ন এক অ্যাপার্টমেন্ট থেকে।
ছেলের জন্মের আগেই হঠাৎ একদিন গায়েব হয়ে যান জন লেননের নাবিক পিতা ফ্রেডি লেনন। পাওয়া যায়নি তার কোনো সন্ধান। বিশ বছর পর একদিন ছেলের সামনে উপস্থিত হন ফ্রেডি। যে জাহাজে ফ্রেডি ছিলেন সেটি শত্রু দেশের হাতে পড়েছিল। তাই তাকে যেতে হয়েছিলো কারাগারে।
জনের যখন চার বছর বয়স, মা জুলিয়া সংসার পাতেন অন্য এক পুরুষের সাথে। অনেকটা ছন্নছাড়াভাবেই বড় হন জন। খালা আর খালু বড় করেন জনকে ।
ছোটবেলা থেকেই যথেষ্ট দুরন্ত ছিলেন জন। গানের প্রতি ছিলো তার দারুণ ঝোঁক। মা জুলিয়া প্রায় ছেলের সাথে দেখা করতে বোনের বাসায় আসতেন। একদিন জনকে তিনি কিনে দেন একটি ব্যাঞ্জো। তবে জনের পছন্দ ছিলো গিটার । মাকে যখন জানালেন সে কথা তখন জনের জীবনের প্রথম গিটার কিনে দিলেন তিনি।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে একটি গাড়ি এক্সিডেন্টে মাতৃহারা হন জন। এই সময় তিনি গানকেই বেছে নিলেন ভালো থাকার আশ্রয় হিসেবে। পরিচয় হয় তার দুই বন্ধু পল ম্যাককার্টনি আর জর্জ হ্যারিসনের সাথে। জনের স্কুল ছিলো কেয়ার ব্যাক স্কুল, অন্য দুজনের লিভারপুল ইনস্টিটিউট। তাদের সাথে যোগ দিলেন জনি হাচ নামের আরও একজন। জর্জ গিটার বাজাতেন, পল আর জন দুজন মিলে গান লিখতেন এবং ড্রাম বাজাতেন জনি হাচ।তারা গড়ে তুললেন কোয়ারিম্যান নামের গানের দল।
এক সময় হাচ চলে গেলেন, দলে আসলেন রিঙ্গো স্টার। ১৯৬০ সালে সৃষ্টি হলো কালজয়ী ‘বিটলস’ ব্যান্ডের। ‘বিটলস’ শুধু একটা নাম নয়, এটা হলো ইতিহাস। ষাটের দশকে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে এক নতুন যুগের সূচনা করে ‘বিটলস’। ক্যাভার্ন ক্লাব থেকে শুরু করে বিবিসি রেডিও সবখানেই ‘বিটলস’-র জয়জয়কার।
ব্রিটেনের মহারানী বিটলসের সদস্যদের দেন এমবিই মেডেল। তবে ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকাকে ব্রিটেনের সমর্থনের প্রতিবাদে চার বছর পর সে মেডেল মহারানীকে ফিরিয়ে দেন জন লেনন।
জন লেনন ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মুখ। জন তার দ্বিতীয় স্ত্রী ইয়োকো ওনোকে বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় করলেন অদ্ভুত এক কাজ। মধুচন্দ্রিমার মাধ্যমে এ নবদম্পতি ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিরোধী বার্তা ছড়িয়ে দিতে তাদের বিয়ের প্রচারকে কাজে লাগিয়ে তাদের 'শান্তির জন্য শয্যা-ইন'-এর প্রথম মঞ্চায়নে আমস্টারডামে উড়ে যান। নব দম্পতি হিলটন প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট বিছানায় একসঙ্গে পায়জামায় বসে কাটিয়ে দিলেন সাত দিন। তাদের মাথার উপরে দুটি প্রতিবাদী চিহ্ন। আর এই প্রতিবাদের সাক্ষী হওয়ার জন্য মিডিয়াকে তাদের কক্ষে আমন্ত্রণ জানালেন।
ওনোর আগে ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে সিনথিয়া পাওয়েলকে বিয়ে করেছিলেন জন। তবে সে বিয়ে টেকেনি বেশিদিন। জুলিয়ান লেনন নামে তাদের একজন সন্তান রয়েছে।
১৯৭০-এ এসে থেমে যায় বিটলসের এই যাত্রাও। যার কারন বিটলসের সদস্যদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত। জন লেনন নিজের মতো করে কাজ করার লক্ষ্যে চলে যান বিটলস ছেড়ে।
১৯৮০ সালের ৮ ডিসেম্বর খুন হন জন লেনন। চ্যাম্পম্যান নামের এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। সে রাতটি ছিলো সঙ্গীত অঙ্গনের কালরাত্রি।