কোটা আন্দোলনকে ঘিরে নজিরবিহীন তাণ্ডবে নরসিংদী জেলা কারাগারে হামলা ও আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। আন্দোলনকারীর বেশে দুর্বৃত্তরা এসময় কারাফটক ভেঙে জেল সুপার ও জেলারকে জিম্মি করে কারাগার থাকা ৮২৬ কয়েদি ও বন্দিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এসময় আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ লুটসহ কারাগারের নথিপত্র আগুনে পুড়িয়ে দেয় তারা।
গত ১৯ জুলাই বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। কারাগারের আবাসিক ব্যারাকেও এসময় হামলা চালানো হয় বলে ২০ জুলাই এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দৈনিক আমাদের সময়।
এদিকে পালিয়ে যাওয়া আসামিদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সন্ত্রাসী ও জঙ্গিরাও ছিলো বলে কয়েকটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে দৈনিক ইত্তেফাক জানায়, বন্দিরা কারারক্ষীদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে দুর্বৃত্তদের সাথে পালিয়ে যায়।
হামলার পর পুলিশ দুর্বৃত্তদের গতিরোধ করার চেষ্টা করলে, দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এসময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট ও টিয়ার গ্যাস ছোড়ে।
এদিকে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ২১ জুলাই অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন জেলার কামরুল ইসলাম। মামলায় উল্লেখ করা হয়, অন্তত ৮২৬ জন আসামি ছিনিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অস্ত্র ও গুলি লুট করা হয়েছে।
সেদিনই ক্ষতিগ্রস্ত কারাগার ঘুরে দেখেন কারা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শক (আইজিপি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ এস এম আনিসুল হক।
কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া আসামিদের নিজ নিজ থানায় আত্মসমর্পণ করতে রোববার মাইকিং করে কারা কর্তৃপক্ষ। বলা হয়, আত্মসমর্পণ না করলে নতুন করে মামলা হবে।
এদিকে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানিয়েছেন, আসামিদের মধ্যে কেউ কেউ জেলখানা ছেড়ে যেতে চাননি। তাদের হামলাকারীরা কারাগার ছেড়ে যেতে বাধ্য করেন।
এ অবস্থায় নিজ থেকে আত্মসমর্পণ করলে আসামিরা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবেন বলে জানান ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি মো. নুরুল ইসলাম।
সেদিন তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, কারাগারে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছে। এর প্রমাণ রয়েছে। নৈরাজ্যের ঘটনায় এরইমধ্যে ৫৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লুট হওয়া কিছু অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে ২১ জুলাই পর্যন্ত পলাতক অন্তত ৪০ থেকে ৫০ জন আসামি কারাগারে ফিরে আসেন। তাদের মধ্যে ছিলেন নরসিংদীর শিবপুরের নোয়াদিয়া এলাকার সাত বছরের সাজাপ্রাপ্ত আসামি স্বপন মিয়া। শনিবার তিনি ফিরে আসেন।
নিজ থেকে যারা ফিরে এসেছেন তাদের প্রায় সবাই একই ধরনের কথা বলেছেন। তারা বলছেন, কারাগারে হামলা ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানির ভয়ে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। অনেক আবার দাবি করেন, তাদের পিটিয়ে বের করে দেয়া হয়।
স্বপন মিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, হামলার সময়ে বাইরে গোলাগুলির আওয়াজ শোনেন তিনি। এক পর্যায়ে দুর্বৃত্তরা কারাগারে মূল ফটক ভেঙে ফেলেন। বিভিন্ন সেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। বন্দিরা ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করেন।
নরসিংদীর জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ ২০ জুলাই গণমাধ্যমকে বলেন, অনেক কয়েদি নিজ থেকে ফিরে এলেও আমরা তাৎক্ষণিক তাদের কারাগারে ফিরিয়ে নিতে পারিনি। সময়মতো নতুন করে ওয়ারেন্ট জারি হলে আসামিদের কারাগারে ফেরত আসতে বলা হয়েছে।
সোমবার নরসিংদী কারাগার থেকে পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন।
তিনি আরও জানান, পালিয়ে যাওয়াদের মধ্যে ওই দিন পর্যন্ত ৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। উদ্ধার করা হয়েছে ২১টি অস্ত্র ও এক হাজার ১০০টি গুলি। এর মধ্যে ১০ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
এদিকে গত শনি, রোব, সোম ও মঙ্গলবারের বিভিন্ন সময়ে ১৩৬ জন আসামির আত্মসমর্পণের তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। পলায়নরত কারাবন্দিরা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর মাধ্যমে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রাকিবুল হকের আদালতে স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করেন।
এছাড়া ৮০ জন আত্মসমর্পণ করেন বুধবার দুপুরে। এদিন দুই জঙ্গিকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় নরসিংদী কারাগারের জেল সুপার ও জেলারকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যারা জেলখানা থেকে বেরিয়ে গেছে, তারা যেন দ্রুত আত্মসমর্পণ করে, সেজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলার প্রতিটি গ্রাম ও ইউনিয়নে মাইকিং করা হচ্ছে।
মঙ্গলবার বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিদের ধরে আইনের আওতায় আনতে যা যা করার দরকার সরকার তার সবই করবে।
যেসব জঙ্গিরা পালিয়ে গেছে তারা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, তারা দু’জন নারী জঙ্গিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কেন এটা হল, কারও গাফিলতি ছিলো কি না, কেউ যোগান দিয়েছিল কি না- সেসব ঘটনা তদন্তে দুটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারাগারের কারও দায়িত্বে অবহেলা থাকলে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
শুক্রবার বিকেলে জেলা কারাগারে হামলার তিন দিন পর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় অরক্ষিত জেলা কারাগার নিয়ন্ত্রণে আনে নিরাপত্তা বাহিনী।